দেড় যুগ ধরে যে হোটেলে একেকটি পেঁয়াজু-বেগুনির দাম ১ টাকা

রমজানে যেখানে সবকিছুর দাম বাড়তি, সেখানে খুলনার ইকবাল হোটেল অ্যান্ড রেস্টুরেন্টে ইফতারসামগ্রীর প্রতিটি বিক্রি হচ্ছে মাত্র ১ টাকায়। ইফতার কিনতে সাধারণ মানুষের ভিড়। খুলনার দৌলতপুরের মহেশ্বরপাশায়ছবি: সাদ্দাম হোসেন

খুলনার দৌলতপুরের মহেশ্বরপাশা কালীবাড়ি বাজার এলাকার ইকবাল হোটেল অ্যান্ড রেস্টুরেন্টের সামনে শুক্রবার ছিল দীর্ঘ লাইন। সেখানে পেঁয়াজু, বেগুনি, আলুর চপ, কাঁচা মরিচের চপের মতো সাধারণ ইফতারি বিক্রি হচ্ছে। ঐতিহ্যবাহী বা বিশেষ কোনো আইটেম না হলেও এখানকার ইফতারির একটা বিশেষত্ব আছে। যে পদই নেওয়া হোক না কেন, একেকটির দাম মাত্র এক টাকা করে। এ কারণেই দোকানে এত ভিড় দেখা যায়।

ইকবাল হোটেল অ্যান্ড রেস্টুরেন্টে এসব ভাজাপোড়ার পদ বিক্রি হয় শুধু রমজান মাসে। অন্য সময় সেখানে সকালে রুটি-ডাল, আর অন্য সময় শুধু চা বিক্রি হয়।

ইকবাল হোটেলে ১ টাকার ইফতার আইটেম বিক্রি হচ্ছে প্রায় দেড় যুগ ধরে। দাম তখনো যা ছিল, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের আকাশচুম্বী দামের এই সময়েও তা-ই আছে। তবে এ জন্য দিতে হচ্ছে ভর্তুকি।

কথায় কথায় জানা গেল, শুরুটা হোটেলের স্বত্বাধিকারী ইকবাল হোসেন (৪৮) একা করলেও এখন তিনি একা নন। পাড়ার আরও ১১ জন তাঁর এই উদ্যোগে শামিল হয়েছেন। তাঁরা সবাই মিলে শ্রম আর অর্থ দিয়ে নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য ইফতারিতে কিছু স্বস্তি আনার চেষ্টা করে যাচ্ছেন। ১২ জনের দলে হিন্দু-মুসলমান সবই আছেন। ১২ জনের প্রায় সবাই ছোটখাটো ব্যবসা করেন মহেশ্বরপাশার কালীবাড়ি বাজার এলাকায়।

শুক্রবার বেলা আড়াইটার দিকে ইকবাল হোটেল অ্যান্ড রেস্টুরেন্টে গিয়ে দেখা যায়, ১৩-১৪ জন ইফতারসামগ্রী প্রস্তুতে ব্যস্ত সময় পার করছেন। কেউ আলুর গোল্লা বানাচ্ছেন, কেউ বেগুন কাটছেন, কেউ আদা-মসলা পিষে দিচ্ছেন, কেউ বেগুনে-মরিচে বেসন লাগাচ্ছেন, কেউ সেগুলো ভাজছেন, কেউবা সেগুলো পাত্রে গুছিয়ে রাখছেন। বেলা সাড়ে তিনটার দিক থেকেই ক্রেতাদের আনাগোনা শুরু হয়। ইকবাল হোসেন ও তাঁর সহযোগীদের ব্যস্ততা তখন বাড়তে থাকে। তখন জনা সাতেক মানুষ হোটেলের ভেতরে থাকেন। বাকিরা সরাসরি বিক্রির কাজে চলে যান। তবে সেখান থেকে ইফতারসামগ্রী নেওয়ার শর্ত, কেউ ২০টার বেশি নিতে পারেন না।

১২ জনের দলের একজন মো. কায়সার রিজভী ট্রাভেল এজেন্সির ব্যবসা করেন। ইফতারসামগ্রী গুছিয়ে দিতে দিতে বলেন, ‘ইকবাল ভাই একাই শুরু করেছিলেন। ভাইয়ের সঙ্গে আমরা আস্তে আস্তে যোগ দিয়েছি। আমাদের সবার বাড়ি এক মহল্লায়। বিকের ৪টা থেকে বিক্রি শুরু করি, এরপর যতক্ষণ চলে। তবে ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যে সব শেষ হয়ে যায়। প্রতিদিন সব মিলিয়ে সাত হাজার পিস ভাজাপোড়া করা হয়।’

ভোর থেকেই শুরু হয় ইকবালদের কর্মযজ্ঞ। খুব ভোরে দৌলতপুর বাজার থেকে বাজার করে সাতটার মধ্যে দোকানে ফেরেন। এরপর বেগুন কাটা, আলু সেদ্ধ তুলে দিতে দিতে কয়েকজন এসে হাজির হন। ওই ১২ জনের অনেকে রমজানের সময় শুধু সকালে নিজ নিজ ব্যবসা চালালেও দুপুরের পর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত সবাই একসঙ্গে কাজ করেন। তাঁদের বাইরেও অনেকে দোকানে এসে সহযোগিতা করে যান।

১২ জনের দলের আরেকজন মো. হাফিজুর শিকদার ভাঙারি ব্যবসা করেন। তিনি বলেন, ‘দুপুর ১২টা পর্যন্ত নিজের ব্যবসার কাজ করেন। এরপর গোসল সেরে এখানে কাজে লেগে পড়ি। আমাদের নিজেদের ছোটখাটো ব্যবসা। তবে রোজার মাসে দুপুরের পর আমি আর বের হই না। আমাদের এখানকার খালেক কাকা যেমন রমজানে সকালের পর আর গ্যারেজ খোলেন না। আমরা সবাই মিলে কাজটা ওঠানোর চেষ্টা করি। খুব ভালো লাগে। এলাকার মানুষও এটাকে খুব ভালোভাবে দেখে।’

ওই দলের একজন শিবুপদ দে বলেন, ‘শুধু রোজার মাসের জন্য এই আয়োজন। রোজা শেষ, এখানকার তেলেভাজা শেষ। এই ভালো কাজে শামিল হতে পেরে আনন্দ পাই। চানরাতে আমরা একটা হিসাব করি। যে ঘাটতি থাকে, আমরা ১২ জন মিলে সেটা দিয়ে দিই। ইকবাল একটু বেশিই দেয়। গত দুই বছরের অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, পুরো মাসে ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকা ঘাটতি থাকে।’

শুরুটা হোটেলের স্বত্বাধিকারী ইকবাল হোসেন একা করলেও এখন তিনি একা নন। পাড়ার আরও ১১ জন তাঁর এই উদ্যোগে শামিল হয়েছেন
ছবি: সাদ্দাম হোসেন

এই উদ্যোগের মূল উদ্যোক্তা ইকবাল হোসেন বলেন, ‘নিজের জায়গায় দোকান। স্ত্রী-সন্তান নেই, পিছুটান নেই। অতিরিক্ত সঞ্চয়ের চিন্তা নেই। সারা বছর আয় করি। যদি ভালো কিছু করা যায়, সেই তাগিদ থেকেই এই উদ্যোগ নিয়েছিলাম। এখন এই কাজ করে অনেক তৃপ্তি পাই। সঙ্গে অনেকে যোগ দিয়েছে, এটাও ভালো লাগে। আরও যদি কেউ সহায়তা করতে চান, তাহলে আমরা পরিসরটা আরও বাড়াতে পারতাম।’