বাবার স্বপ্ন পূরণ করতে রাশিয়ার সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়েছিলেন ইয়াসিন

ইয়াসিন শেখের মৃত্যুর খবরে মা ফিরোজা খাতুনের আহাজারি। ময়মনসিংহের গৌরীপুরের মরিচালি গ্রামে। গতকাল বৃহস্পতিবার তোলা
ছবি: প্রথম আলো

ইয়াসিন মিয়া শেখ (২২) সেনাবাহিনীতে যোগ দেবেন—এমন স্বপ্ন ছিল তাঁর প্রয়াত বাবার। সেই স্বপ্ন পূরণ করতে রাশিয়ান সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়ে সেনাপোশাকটি উৎসর্গ করেছিলেন বাবাকে। এর মাধ্যমে সেনাবাহিনীতে যোগ দেওয়ার স্বপ্ন পূরণ হলেও যুদ্ধে শেষ হয়ে গেছে ইয়াসিনের স্বপ্নযাত্রা। তাঁর মৃত্যুতে পরিবারে নেমে এসেছে শোকের ছায়া।

ইয়াসিন মিয়া ময়মনসিংহের গৌরীপুর উপজেলার ডৌহাখলা ইউনিয়নের মরিচালি গ্রামের মৃত আবদুস সাত্তার শেখের ছেলে। স্বজনেরা জানান, ইয়সিনরা তিন ভাই ও এক বোন ছিলেন। এর মধ্যে বোন ও এক ভাই ছোটবেলায় মারা যান। মা ও বড় ভাইয়ের সঙ্গে থাকতেন ইয়াসিন। বড় ভাই ব্যবসায়ী রুহুল আমিন তাঁর পড়াশোনা ও বিদেশযাত্রার খরচ বহন করেন। পারিবারিক ৪০ শতাংশ জমি বিক্রি করা হয় ৭ লাখ টাকায়। ঋণ করে আরও ৮ লাখ টাকা মিলিয়ে ১৫ লাখ টাকার জোগান দেন বড় ভাই।

আরও পড়ুন

গত বছরের ৪ সেপ্টেম্বর রাশিয়ার উদ্দেশে দেশ ত্যাগ করেন ইয়াসিন। দেশ ছাড়ার আগে নিজের ফেসবুকে একটি ভিডিও পোস্ট করেন। উত্তরার একটি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে রাশিয়ায় যাচ্ছেন বলে ওই ভিডিওতে জানিয়েছিলেন ইয়াসিন শেখ। তিনি ঢাকার পল্লবীর সরকারি বঙ্গবন্ধু কলেজের ডিগ্রি ২০২২-২০২৩ সেশনের শিক্ষার্থী ছিলেন।

গত বছরের ২২ ডিসেম্বর রাশিয়ার সেনাবাহিনীতে চুক্তিভিত্তিক যোদ্ধা হিসেবে যোগ দেন ইয়াসিন শেখ। চুক্তি স্বাক্ষরের কাগজটি নিজের ফেসবুকে প্রকাশ করে তাতে লেখেন, ‘জীবনের সবচেয়ে বড় স্বাক্ষর করলাম।’ চলতি বছরের ১৯ জানুয়ারি সেটি নিজের ফেসবুকে প্রকাশ করেন।

রাশিয়ার সেনাবাহিনীর পোশাকে ইয়াসিন মিয়া
ছবি: সংগৃহীত

ইয়াসিনের বাবা আবদুস সাত্তার শেখ ২০১৬ সালে মারা যান। ছেলে ইয়াসিন সেনাবাহিনীতে চাকরি করবেন, সে স্বপ্ন ছিল তাঁর বাবার। সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে ইয়াসিন কয়েকবার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন বলে জানান বড় ভাই রুহুল আমিন। তাঁর দাবি, সেনাবাহিনীতে একবার টিকলেও ছাত্রদলের রাজনীতি করায় তাঁর ভাইকে ডেকে নিয়ে নিয়োগপত্র কেড়ে নেওয়া হয়েছিল। তিনি জানান, সেনাবাহিনীতে চাকরি না হওয়ায় আক্ষেপ ছিল তাঁর ভাইয়ের। কিন্তু রাশিয়ায় সেনাবাহিনীতে যোগ দেবেন, সেটি তাঁদের জানা ছিল না।

রুহুল আমিন বলেন, ‘আমার ভাই খুব ট্যালেন্ট ছিল। তাই সে যা–ই বলত, আমি শুধু টাকার জোগান দিতাম। সে একাই সব প্রক্রিয়া করে রাশিয়ায় গিয়ে বাবার স্বপ্ন পূরণে সেনাবাহিনীতে যোগ দেয়। ভাই মারা গেছে, এটি খুব কষ্টের। কিন্তু মানুষের কাছ থেকে ঋণ করে বিদেশে পাঠিয়েছি, সেই ঋণের টাকা তো আর কেউ ছাড় দেবে না৷ সরকার যদি আমার দিকে মুখ তুলে তাকায়, তাহলে কিছুটা রক্ষা।’

রাশিয়ার হয়ে ইউক্রেন যুদ্ধে অংশ নেওয়ার ছবি ও ভিডিও নিয়মিত নিজের ফেসবুক অ্যাকাউন্টে আপলোড করতেন ইয়াসিন মিয়া শেখ। গত ১ মার্চ ফেসবুকে তাঁর বাবার মৃত্যুবার্ষিকীতে রাশিয়া যাওয়া, সেনাবাহিনীতে যোগ দেওয়া এবং তাঁর স্বপ্ন পূরণ নিয়ে একটি ভিডিও আপলোড করে ইয়াসিন। ভিডিও প্রকাশ করে তাতে ইয়াসিন শেখ উল্লেখ করেন, ‘আমার বাবার স্বপ্ন পূরণের আশায় ছিলাম। প্রায় ৯ বছর পর সেই স্বপ্ন পূরণ হয়েছে। সে স্বপ্ন আমায় এই ৯টি বছর কাঁদিয়েছে, যে স্বপ্ন আমার বাংলাদেশের পূরণ হয়নি, সেই স্বপ্ন দূর প্রবাসে এসে পূরণ হয়েছে। আজকে আমার বাবাকে অনেক মিস করছি। আমার হৃদয়ের স্পন্দন আমার বাবা কী শুনতে পাচ্ছে কি না, জানি না। আমার বাবার স্বপ্ন এই পোশাক আমার বাবাকে উৎসর্গ করলাম।’

ভিডিওতে ইয়াসিন শেখ আরও উল্লেখ করেন, ‘এখানে আসার অনেকটা পথ কঠিন হয়ে পড়ে। আমার নিজের ইচ্ছায় এই সৈনিকে যোগ দেওয়া। মস্কো থেকে প্রায় ১১ হাজার কিলোমিটার দূরে আমি জব পেয়েছিলাম। ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে আমি চায়নার একটি কোম্পানিতে ইন্টারভিউ দিয়েছিলাম। ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর সেপ্টেম্বরে আমার অফার লেটার এলে রাশিয়াতে গিয়ে তিন মাস জব করি। তারপর স্বেচ্ছায় অনলাইনের মাধ্যমে আমি রাশিয়ার সৈনিকে যোগ দিই।’

ভিডিও প্রকাশের কারণ হিসেবে ইয়াসিন উল্লেখ করেন, ‘আমি বলতে চাই, এভাবে ভিডিও প্রকাশ করতে চাইনি। পুরোটাই গোপন করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু বেসরকারি একটি টেলিভিশনে আমার দুটি ছবি প্রকাশ হলে প্রতিবেশীরা অনেকে আমাকে ফেসবুকে মেসেজ দিতে থাকে—আমি কেমন আছি এসব জানতে চায়।’ তাঁদের উদ্দেশে ইয়াসিন বলেন, ‘আমি এখন পর্যন্ত আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি।’

ছাত্রদলের কর্মী হিসেবে বিগত সময়ে আন্দোলন, মিছিল মিটিংয়ের স্মৃতিও তুলে ধরেছিলেন ইয়াসিন। তিনি বলেন, ‘দেশে সরকারিবিরোধী আন্দোলনে যোগ দিয়ে সাহস তৈরি হয়। তারপর বাবার যে স্বপ্ন সৈনিক হওয়ার। রাশিয়াতে নিজের পরিকল্পনায় বাবার স্বপ্ন পূরণ করার জন্য যদি যুদ্ধ করতে হয়, তাহলেও আমি প্রস্তুত। এই কথা ভেবে আমি রাশিয়ার সেনাতে যোগ দিই। আমি যুদ্ধকে ভয় পাই না, একমাত্র আল্লাহকে ভয় পাই। কারণ, জন্ম–মৃত্যু উনি লিখেছেন। এখানে যদি আমার মৃত্যু হয়, তাহলে তাঁর আদেশেই আমার মৃত্যু হবে।’

ভিডিও ফেসবুকে পোস্ট করার মাস না পেরুতেই যুদ্ধে ইউক্রেনের মিসাইল হামলায় নিহত হন ইয়াসিন শেখ। সর্বশেষ ১১ মার্চ রাশিয়ান সেনাবাহিনীর পোশাক পরা ছবি পোস্ট করে তাতে ইয়াসিন লিখেছিলেন, ‘মানুষের জীবনে কঠিন সময় আসে আমাদের শক্তি আর সাহসকে পরীক্ষা করার জন্য। কঠিন সময়ে ধৈর্য ধরাই প্রকৃত সাহসের পরিচয়।’

২৭ মার্চ ইয়াসিন শেখ নিহত হলেও স্বজনেরা জানতে পারেন ঈদের পরের দিন গত মঙ্গলবার। রাশিয়ায় থাকা ইয়াসিনের বন্ধু মেহেদী হাসান মুঠোফোনে ইয়াসিনের বড় ভাই রুহুল আমিনকে মৃত্যুর খবর দেন। ইয়াসিনের মৃত্যুর খরব জানাজানি হওয়ার পর পরিবারটিতে শোকের ছায়া নেমে এসেছে।

আজ রোববার সকাল সাড়ে ৯টার দিকে ইয়াসিন শেখের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায় নীরবতা। বড় ভাই রুহুল আমিন বলেন, ‘ইয়াসিনের জন্য কাঁদতে কাঁদতে মা অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। গত রাতে ঘুমের ওষুধ খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে রেখেছি।’ তিনি বলেন, ‘ভাই হারিয়ে আমিও কথা বলার শক্তি হারিয়ে ফেলছি। ভাইয়ের লাশের জন্য প্রশাসনের মাধ্যমে আবেদন করেছি, বিএনপি নেতারাও বাড়িতে এসে আশ্বস্ত করেছেন। এখন অপেক্ষা করা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই।’

এ বিষয়ে গৌরীপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এম সাজ্জাদুল হাসান বলেন, যুদ্ধে অংশ নিয়ে যুবক নিহত হওয়ার খবর পেয়ে গত বৃহস্পতিবার সহকারী কমিশনার (ভূমিকে) পাঠানো হয়েছিল। পরিবার একটি লিখিত আবেদন করেছে। সরকারের যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে সেই আবেদনটি পাঠানো হবে। বিধি অনুযায়ী সব পদক্ষেপ সংশ্লিষ্ট দপ্তর গ্রহণ করবে। উপজেলা প্রশাসন থেকে সার্বিক সহযোগিতা থাকবে।

বিষয়টি নিয়ে প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডের ওয়েল ফেয়ার সেন্টার ময়মনসিংহের সহকারী পরিচালক মাহবুবুল হাসান তাহেরির মুঠোফোনে একাধিকবার যোগাযোগ করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি।