অস্ত্রোপচার বন্ধ ১৫ বছর

এখানে গাইনি, সার্জারি, অ্যানেসথেসিয়াসহ বিশেষজ্ঞের ১০টি পদ শূন্য। এতে এখানে এসে রোগীরা কাঙ্ক্ষিত সেবা পাচ্ছেন না।

বরগুনার পাথরঘাটা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের প্যাথলজি বিভাগের সামনে রোগীদের ভিড়। গত রোববার দুপুর ১২টায় তোলা ছবি।
প্রথম আলো

‘যে রোগের চিকিৎসার জন্য ডাক্তার দেখাতে আসি, সেই ডাক্তার পাওয়া যায় না। আবার যেসব ডাক্তার আছেন, তাঁদের কক্ষের সামনে রোগীদের প্রচণ্ড ভিড়। এ ভিড়ের কারণে বেলা ১১টায় টিকিট কেটে লাইনে দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর বেলা পৌনে একটায় ডাক্তারের কক্ষে ঢোকার সুযোগ পেয়েছি।’

বরগুনার পাথরঘাটা উপজেলার চরলাঠিমারা গ্রামের নাসিমা বেগম উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসা নিতে এসে গত রোববার এসব কথা বলেন। চিকিৎসক–সংকটে নাসিমা বেগমের মতো অনেক রোগীকে এখানে চিকিৎসা নিতে এসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হচ্ছে। আবার গাইনি ও সার্জারি বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক না থাকায় রোগীরা এখানে এসে কাঙ্ক্ষিত সেবা পাচ্ছেন না। অবেদনবিদ না থাকায় এখানে ১৫ বছর ধরে অস্ত্রোপচার বন্ধ। আর এক্স–রে যন্ত্র বাক্সবন্দী থাকায় রোগীদের দীর্ঘদিন ধরে বাইরে গিয়ে অতিরিক্ত টাকা খরচ করে এক্স–রে করাতে হচ্ছে। শুধু এক্স–রে করানোই নয়, এই স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের মেডিকেল টেকনোলজিস্টের ছয়টি পদের মধ্যে পাঁচটিই শূন্য থাকায় নানা ধরনের স্বাস্থ্য পরীক্ষা বাইরের ডায়াগনস্টিক সেন্টারে করতে হয়। চিকিৎসক ও টেকনলজিস্ট–সংকটে এখানে চিকিৎসাসেবা কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে।

উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স সূত্র জানায়, ৫০ শয্যার উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ২৮ জন চিকিৎসকের মধ্যে ১৭টি পদ শূন্য। এগুলো হচ্ছে কনিষ্ঠ বিশেষজ্ঞ (সার্জারি, মেডিসিন, গাইনি, অ্যানেসথেসিয়া, শিশু, অর্থপেডিক্স, কার্ডিওলজি, চক্ষু, চর্ম ও যৌন, নাক–কান–গলা), ডেন্টাল সার্জন, সহকারী সার্জন (রেডিওলজিস্ট), চিকিৎসা কর্মকর্তা (ইউনানী), চিকিৎসা কর্মকর্তা এবং সহকারী সার্জনের তিনটি পদ। এখানে আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা, তিনজন চিকিৎসা কর্মকর্তা ও সাতজন সহকারী সার্জন কর্মরত আছেন।

পাঘরঘাটা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের বহির্বিভাগে ২০০ থেকে ২৫০ রোগী চিকিৎসা নেন। অন্তর্বিভাগে পুরুষ ও নারী ওয়ার্ডে ৩০ থেকে ৪০ জন রোগী চিকিৎসাধীন থাকেন। তবে নতুন করে চালু হওয়া ডেঙ্গু ওয়ার্ডে এখন ১৫ থেকে ২০ জন রোগী ভর্তি থাকেন।

গত রোববার দুপুর ১২টায় সরেজমিনে দেখা যায়, কালমেঘা ইউনিয়নের মুন্সীগঞ্জ এলাকার দিলীপ মাতুব্বর (৪৮) ডেঙ্গু ওয়ার্ডে ভর্তি। ওই রোগীর স্বজন অনিল মাতুব্বর রক্ত পরীক্ষার রিপোর্ট নেওয়ার জন্য হাসপাতালের ল্যাবের সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছেন। কিন্তু তাঁর মতো আরও অর্ধশতাধিক বিভিন্ন রোগী ও তাঁদের স্বজনেরা দাঁড়িয়ে থাকায় ভিড় সামলে ভেতরে গিয়ে তিনি কথা বলতে পারছেন না।

এ সময় চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র নিয়ে পাথরঘাটা সদর ইউনিয়নের চরলাঠিমারা গ্রামের আবদুস সালাম (৫৫) হাসপাতালে এক্স–রে রুম খুঁজছেন। অপর এক রোগীর স্বজন জানালেন, হাসপাতালে দীর্ঘদিন ধরে এক্স–রে বন্ধ। আপনাকে বাইরে থেকে এক্স–রে করে আনতে ৪০০ থেকে ৪৫০ টাকা টাকা খরচ হবে।

এ সময় আবদুস সালাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘বাড়ি থেকে ২০০ টাকা নিয়ে এসেছিলাম। এর মধ্যে হাসপাতালে আসতে ৪০ টাকা, ১৫ টাকার রুটি ও ৫টার চা খেয়েছি। এখন যাওয়ার শুধু ৪০ টাকা বাদে ওষুধ কেনার ১০০ টাকা হাতে আছে। এখন কী করে বুকের এক্স–রে করব। এত টাকা কই পাব।’

উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স সূত্রে জানা গেছে, একজন মেডিকেল টেকনলজিস্টের অভাবে ১৫ বছরেরও বেশি সময় ধরে এক্স–রে যন্ত্রটি বাক্সবন্দী ছিল। ছয় মাস আগে এক্স–রে যন্ত্রটি মির্জাগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ফেরত পাঠানো হয়। সম্প্রতি পাশের বেতাগী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকে একটি এক্স–রে যন্ত্রটি আনা হলেও মেডিকেল টেকনোলিজস্ট নিয়োগ না দেওয়ায় এটি চালু করা যাচ্ছে না।

জানতে চাইলে পাথরঘাটা উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা মাসুদ রানা প্রথম আলোকে বলেন, ‘চিকিৎসক ও মেডিকেল টেকনোলজিস্টের সংকট নিয়ে কাজ করতে কিছুটা বেগ পেতে হচ্ছে। তবে হাসপাতালের চিকিৎসাসেবা ও সৌন্দর্যবর্ধনসহ স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতকরণে যথাসাধ্য চেষ্টা করে যাচ্ছি।’ তিনি আরও বলেন, চিকিৎসকসহ অন্যান্য শূন্যপদ পূরণের জন্য কিছুদিন পর পর স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বরিশাল বিভাগীয় কার্যালয়ে চিঠি পাঠানো হয়। কিন্তু এখন পর্যন্ত শূন্যপদ পূরণ করা হয়নি।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বরিশাল বিভাগীয় কার্যালয়ে ভারপ্রাপ্ত পরিচালক শ্যামল চন্দ্র হাওলাদার প্রথম আলোকে বলেন, চিকিৎসক, মেডিকেল টেকনোলজিস্টের শূন্যপদগুলো দ্রুত পূরণ করা হবে। এ ছাড়া এক্স–রে যন্ত্র চালু করাসহ হাসপাতালে সমস্যা সমাধানে বরগুনা সিভিল সার্জন সঙ্গে কথা বলে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেয়া হবে।