সরু গলি, অগ্নিকাণ্ডের ঝুঁকি

নারায়ণগঞ্জে সবচেয়ে বেশি অগ্নিকাণ্ডের ঝুঁকির তালিকায় ওই শিল্প এলাকা রয়েছে বলে জানিয়েছেন ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা।

সরু গলিতে পথচারীদের মাথার ওপরই বিদ্যুতের তারের জঞ্জাল। অগ্নিকাণ্ডের ঝুঁকিতে নারায়ণগঞ্জের নয়ামাটি এলাকার হোসিয়ারি কারখানাগুলো
ছবি: প্রথম আলো

সরু গলি ও গা ঘেঁষে অসংখ্য ভবন, সব মিলিয়ে ঘিঞ্জি এক পরিবেশ। এসবের মধ্যেই চলছে নারায়ণগঞ্জ শহরের নয়ামাটি হোসিয়ারিশিল্প। সেখানে বছরে প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকার লেনদেন হয়। অথচ এই হোসিয়ারিশিল্প এলাকার সার্বিক অবকাঠামো একেবারেই নড়বড়ে। বেশি আতঙ্ক অগ্নিকাণ্ডের ঝুঁকি নিয়ে। বড় ধরনের অগ্নিকাণ্ড ঘটলে জানমাল বাঁচানোর উপায় থাকবে না। সরু গলি দিয়ে অগ্নিনির্বাপণে ফায়ার সার্ভিসের সরঞ্জাম আনার কোনো ব্যবস্থা নেই। নেই পর্যাপ্ত জলাশয়।

ছোট ছোট কয়েকটি অগ্নিকাণ্ডের পর নয়ামাটি হোসিয়ারিশিল্প এলাকার ব্যবসায়ী ও শ্রমিকদের উদ্বেগের শেষ নেই। প্রতিনিয়ত ঝুঁকি নিয়ে কাজ করছেন তাঁরা।

নারায়ণগঞ্জে সবচেয়ে বেশি অগ্নিকাণ্ডের ঝুঁকির তালিকায় ওই শিল্প এলাকা রয়েছে বলে জানিয়েছেন ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা। তাঁরা বলেন, অগ্নিকাণ্ড প্রতিরোধে রাস্তা সম্প্রসারণ করা না গেলেও ওই এলাকায় ‘ফায়ার হাইড্রেন্ট’ স্থাপন করা জরুরি। এর মাধ্যমে আগুন নেভানোর জন্য অন্তত পর্যাপ্ত পানি সরবরাহ করা যাবে।

ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স নারায়ণগঞ্জ কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক আবদুল্লাহ আল আরেফিন প্রথম আলোকে বলেন, নয়ামাটি হোসিয়ারিশিল্পে আগুন নেভাতে প্রধান প্রতিবন্ধকতা সরু গলি ও পানির অপর্যাপ্ততা। ফায়ার হাইড্রেন্ট স্থাপন করা হলে, আগুন লাগলে দ্রুত সেখান থেকে পানি নিয়ে নেভানো সম্ভব হবে।

সরেজমিনে দেখা গেছে, শহরের নয়ামাটি এসএম মালেহ রোড সরু গলি দিয়ে ভেতরে ঢুকতেই চোখে পড়ে কয়েক শ বহুতল ভবন। এক ভবন অন্য ভবনের গা ঘেঁষে গড়ে উঠেছে। ভবনগুলোর সামনে সরু গলির দুই পাশে দোকানগুলোতে হোসিয়ারি গদিঘর।

গদিঘরগুলোতে হোসিয়ারি পণ্য সকাল থেকে রাত অবধি কেনাবেচায় ব্যস্ত থাকেন ব্যবসায়ীরা। দোকানঘরের ওপরে আবার হোসিয়ারি কারখানা ও আবাসিক বাড়ি। সেখানে শ্রমিকেরা হোসিয়ারি পণ্য তৈরি করেন। সরু গলিতে একটি রিকশা ঢুকলে আরেকটি পাশাপাশি চলতে পারে না। বড় ধরনের অগ্নিকাণ্ডে পরিস্থিতি কী দাঁড়াবে, তা সহজেই অনুমেয়।

ব্যবসায়ী শওকত আলী বলেন, নয়ামাটি হোসিয়ারিশিল্প মারাত্মক অগ্নিকাণ্ডের ঝুঁকিতে রয়েছে। বেশ কয়েকবার আগুন লেগেছে। ঝুঁকি নিয়েই ব্যবসা পরিচালনা করতে হচ্ছে তাঁদের। বৃষ্টি টেক্সটাইলের মালিক আবদুল হাই বলেন, কাপড় থেকে পোশাক তৈরি করা হয়। যদি আগুন লাগে, দ্রুত তা পাশের কারখানাগুলোতে ছড়িয়ে পড়ার ঝুঁকি রয়েছে। নয়ামাটিতে আগুন লাগলে ভয়াবহ অবস্থা হবে।

সোহেল টেক্সটাইলের মালিক সোহেল আহমেদ বলেন, প্রতিটি কারখানা ও দোকানঘরে লাখ লাখ টাকার মাল মজুত থাকে। আগুন লাগলে ব্যবসায়ীদের পথে বসতে হবে। অগ্নিকাণ্ড প্রতিরোধে প্রশাসনের দ্রুত উদ্যোগ নেওয়া দরকার বলে মনে করেন হোসিয়ারি কারখানার মেশিন অপারেটর শাহনাজ আক্তার। তিনি বলেন, প্রতিদিনই ঝুঁকি নিয়ে কাজ করতে হয় তাঁদের।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০২১ সালের ৩ মে রাতে নয়ামাটির অর্চনা মার্কেটের চতুর্থ তলায় একটি হোসিয়ারি গুদামে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। ফায়ার সার্ভিসের ছয়টি ইউনিট দুই ঘণ্টা চেস্টা চালিয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। এর আগে ২০২০ সালের ৩১ ডিসেম্বর সকালে নয়ামাটি অ্যাডভান্সড হোসিয়ারির গুদামে আগুন লাগে। এ সময় আশপাশে আগুনের আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। এ ছাড়া প্রায়ই ছোটখাটো অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা।

হোসিয়ারি অ্যাসোসিয়েশন সূত্রে জানা গেছে, স্যান্ডো গেঞ্জি দিয়ে প্রায় ১০০ বছর আগে নয়ামাটি হোসিয়ারিশিল্পের যাত্রা শুরু। বর্তমানে নয়ামাটি, উকিলপাড়া, দেওভোগ, সদরঘাটসহ বিভিন্ন স্থানে মোট সাড়ে ৮ হাজার হোসিয়ারি কারখানা রয়েছে। তবে অ্যাসোসিয়েশনের সদস্যভুক্ত কারখানার সংখ্যা সাড়ে ৩ হাজার। এই শিল্পে জড়িত শ্রমিকের সংখ্যা সাড়ে ৪ লাখের বেশি। বছরে দুই–আড়াই হাজার কোটি টাকার ব্যবসা হয়।

হোসিয়ারি কারখানাগুলোতে স্যান্ডো গেঞ্জি ছাড়াও অন্তর্বাস, ব্রা, টি-শার্ট, মোজা, মেয়েদের ফ্রক, প্লাজো, টুপিসহ বিভিন্ন পণ্য তৈরি হচ্ছে। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে এসব হোসিয়ারি পণ্য সরবরাহের পাশাপাশি সৌদি আরব, দুবাই, বাহরাইন, মালয়েশিয়াসহ বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হচ্ছে, জানান ব্যবসায়ীরা। তাঁদের অভিযোগ, এ হোসিয়ারিশিল্প শত বছরের পুরোনো হলেও অনেক সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত তাঁরা।

বাংলাদেশ হোসিয়ারি অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি নাজমুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, ‘অগ্নিকাণ্ডের ঝুঁকির বিষয়টি নিয়ে আমরা অনেক চিন্তিত। এতগুলো ভবন ভেঙে রাস্তা সম্প্রসারণ করার সুযোগ নেই। কারখানাগুলোতে বাধ্যতামূলক ফায়ার এক্সটিংগুইসার রাখার নির্দেশনা দিলেও অনেক মালিক তা মানেননি। শুধু দোকানঘর রেখে হোসিয়ারি কারখানাগুলো অন্যত্র সরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। এতে আগুনের ঝুঁকি অনেকাংশে কমে আসবে।’