টানা দ্বিতীয় দিনে চুয়াডাঙ্গায় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা, জনজীবন হাঁসফাঁস

টানা তাপপ্রবাহে প্রাণ ওষ্ঠাগত। ছাতা নেই। অগত্যা গামছা মাথায় পথে ছুটে চলে চলেছেন তিন দিনমজুর। বুধবার বিকেলে কেদারগঞ্জ এলাকায়ছবি: প্রথম আলো

চুয়াডাঙ্গায় তাপমাত্রা বেড়েই চলেছে। পরপর দুই দিন জেলায় তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের ওপরে। তীব্র তাপপ্রবাহ অব্যাহত থাকায় সাধারণ মানুষের হাঁসফাঁস অবস্থা। জরুরি প্রয়োজন ছাড়া মানুষ তেমন ঘরের বাইরে বের হচ্ছে না। ধান, আম, লিচু ও সবজির ফলন এবং হাঁস–মুরগি ও গরু-ছাগল নিয়ে কৃষকেরা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন।

পৌর এলাকার হাটকালুগঞ্জ প্রথম শ্রেণির আবহাওয়া পর্যবেক্ষণাগার আজ বুধবার বেলা তিনটায় জেলার সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করেছে ৪০ দশমিক ৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস। পর্যবেক্ষণাগারের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা জামিনুর রহমান জানান, সন্ধ্যা ৬টায় তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ৪০ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস, যা চলতি মৌসুমে সারা দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা। গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে তাপমাত্রা ছিল ৪০ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস।

জামিনুর আরও বলেন, ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের ওপরে তাপমাত্রা হলে তাকে তীব্র তাপপ্রবাহ বলা হয়ে থাকে। চলতি মৌসুমে এ নিয়ে তিন দিন জেলার ওপর দিয়ে তীব্র তাপপ্রবাহ বইছে। সামনের দিনে তাপমাত্রা আরও বাড়তে পারে।

আজ বিকেল চারটায় শহরের কেদারগঞ্জ মালোপাড়া এলাকায় ভ্যানে ফেরি করে বিস্কুট বিক্রি করছিলেন পৌর এলাকার সাতগাড়ির বাসিন্দা আবদুর রাজ্জাক। ঘেমে একাকার আবদুর রাজ্জাক (৫৫) বলেন, ‘গরমে বেশি দূর বাইরি যাওয়া যাচ্চে না, বেচাকিনাও সেরাম হচ্চে না। অ্যাকন ইনকাম খুপই কোম। দিনি ৩০০ ট্যাকার বেশি হচ্চে না। গরমের আগে ৬০০–৭০০ ট্যাকা ইনকাম হইত।’

আবদুস সামাদ নামের এক নির্মাণশ্রমিক বলেন, ‘আমরা কি আর শক কইরে রোদি পুড়তি আইচি। বাড়ি বইসে থাকলি তো প্যাট চলে না ভাই।’

এদিকে তীব্র তাপপ্রবাহের কারণে ফল ও ফসল রক্ষায় কৃষকেরা চিন্তিত হয়ে পড়েছেন। ধান ও সবজিখেত এবং আম ও লিচুর পরিচর্যায় বাড়তি পরিশ্রমসহ অতিরিক্ত খরচ জোগাতে গিয়ে হিমশিম অবস্থা তাঁদের। সদর উপজেলার টেংরামারী-খেজুরতলা গ্রামের কৃষক কাসেদ আলী জানান, ধানের খেতে বাড়তি সেচ দিয়েও পানি ধরে রাখা যাচ্ছে না। এই গরমে ঘর থেকে বের হতে মন চায় না। কিন্তু বের না হলে তো ধান পুড়ে যাবে।

চুয়াডাঙ্গা পৌর এলাকার সবুজপাড়ার বাসিন্দা জেলা আম-ফল ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি আবদুল কুদ্দুস মহলদার জানান, তাঁর ১০০ বিঘার বাগানে অধিকাংশ গাছেই কোনো আম ধরেনি। কিছু গাছে অল্প কিছু ধরলেও ১৫ দিন ধরে তাপমাত্রা বাড়তে থাকায় ব্যাপকভাবে আমের গুটি ঝরে পড়ছে।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর চুয়াডাঙ্গার উপপরিচালকের কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, চলতি মৌসুমে জেলায় ৩৫ হাজার ৫২০ হেক্টর জমিতে বোরো ধান, ২ হাজার ৫০০ হেক্টর জমিতে আম এবং ৬ হাজার হেক্টর জমিতে সবজির আবাদ করা হয়েছে। ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি তাপমাত্রা হলে ধানের পরাগায়ন ঝুঁকিতে পড়ে, আম ও লিচু ঝরে পড়ে এবং সবজি পুড়ে ক্ষতি হয়। এ জন্য ধানখেতে ৫–৭ সেন্টিমিটার পানি রাখা এবং আম, লিচু ও সবজিখেতে পানি স্প্রে করতে হবে।

মুরগির খামারি মাসুদ সরদার জানান, তীব্র তাপপ্রবাহে খামারের বেশির ভাগ মুরগি অসুস্থ হয়ে পড়ছে। মাঝেমধ্যে কিছু কিছু মারাও যাচ্ছে। আলমডাঙ্গা উপজেলার কালীদাসপুর ইউনিয়নের শ্রীরামপুর গ্রামের খামারি হীরা খাতুনের খামারে মঙ্গলবার পর্যন্ত ২৮টি গরু ছিল। গতকাল ৫টি গরু ১৪ লাখ ৭৬ হাজার টাকায় বিক্রি করেছেন। হীরা বলেন, তাপপ্রবাহ বেড়ে যাওয়ায় গরুর গায়ে জ্বর আসছে। গরু খাওয়া ছেড়ে দিচ্ছে। এতে গরু টিকিয়ে রাখাই দায় হয়ে পড়েছে। চিকিৎসা করেও আশানুরূপ ফল পাওয়া যাচ্ছে না।

জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) মোস্তাফিজুর রহমান জানান, তাপপ্রবাহ চলাকালে গরুকে গোয়াল থেকে বাইরে বের করতে কৃষকদের বারণ করা হচ্ছে। সেই সঙ্গে অতিরিক্ত খাবার দেওয়া বন্ধ ও ভিটামিন সি খাওয়াতে পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে।

জেলা প্রশাসক কিসিঞ্জার চাকমা জানান, চলমান তাপপ্রবাহে করণীয় বিষয়ে জেলার সিভিল সার্জনের সঙ্গে কথা বলেছেন। এ সময় স্বাস্থ্যঝুঁকি এড়াতে করণীয় বিষয়ে স্বাস্থ্যবার্তা ছাপিয়ে বিলি করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া প্রাথমিকভাবে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের জন্য খাবার স্যালাইন দেওয়ার বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন আছে।