রংপুরে ন‌‌দীর চরে আশ্রয়ণ প্রকল্প, ঘরের জানালা পর্যন্ত পানিতে ডুবে আছে

টানা বর্ষণে চিকলী নদীর চরে আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘর পানিতে ডুবে গেছে। গতকাল বিকেলে রংপুরের বদরগঞ্জের চম্পাতলী এলাকায়
ছবি: প্রথম আলো

রংপুরের বদরগঞ্জ উপজেলার দামোদরপুর ইউনিয়নের চম্পাতলী এলাকার আশ্রয়ণ প্রকল্পের ৭৪টি পাকা ঘর চার দিন ধরে এখন পানির নিচে। গত শুক্র ও শনিবারের টানা বর্ষণে চিকলী নদীর পানিতে ওই ঘরগুলো জানালা পর্যন্ত ডুবে রয়েছে।

ওই আশ্রয়ণ প্রকল্পের দেড় শতাধিক মানুষ পাশের দুটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আশ্রয় নিয়েছেন। প্রশাসনের পক্ষ থেকে তাঁদের খাদ্য সরবরাহ করা হচ্ছে।

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, তিন বছর আগে উপজেলা প্রশাসনের তত্ত্বাবধানে প্রায় দেড় কোটি টাকা ব্যয়ে চিকলী নদীর জেগে ওঠা চরে মুজিব বর্ষ উপলক্ষে ওই ঘরগুলো নির্মাণ করা হয়।

নদীর চরে নিচু জায়গায় ওই ঘরগুলো নির্মাণ করা ঠিক হয়নি। সেখানকার বাসিন্দাদের সরিয়ে স্কুলে রাখা হয়েছে।
শেখ আবু বক্কর সিদ্দিক, দামোদরপুর ইউপির চেয়ারম্যান

এলাকার লোকজনের অভিযোগ, যে জায়গায় ঘরগুলো নির্মাণ করা হয়েছে, সেখানে ১০ বছর আগে নদীর প্রবাহ ছিল। পরে নিচু জায়গায় জেগে ওঠা চরে আশ্রয়ণের ঘরগুলো নির্মাণ করা হয়।

গতকাল বুধবার বিকেলে গিয়ে দেখা গেছে, ওই আশ্রয়ণ প্রকল্পের সব কটি ঘর জানালা পর্যন্ত পানিতে ডুবে আছে। ঘরের ভেতরে বুকসমান পানি। প্রকল্পের যাওয়া আসার রাস্তাটি অন্তত ১০ ফুট পানির নিচে ডুবে রয়েছে।

আশ্রয়ণ প্রকল্পে বসবাসরত অন্তত ২০ জন বাসিন্দা জানিয়েছেন, শনিবার রাতে হঠাৎ ঘরের মধ্যে হড়হড় করে নদীর পানি ঢুকে পড়ে। খবর পেয়ে দ্রুত সেখানে ছুটে আসেন ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা। তাঁরা প্রকল্পের বাসিন্দাদের উদ্ধার করে উঁচু স্থানে নিয়ে যান। তখন থেকে আশ্রয়ণের বাসিন্দারা স্থানীয় চম্পাতলী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও চম্পাতলী উচ্চবিদ্যালয়ে রয়েছেন।

চম্পাতলী উচ্চবিদ্যালয়ে আশ্রয় নেওয়া আবদুল হাকিম মিয়া (৭০) বলেন, তিনি স্ত্রীসহ তিন সন্তান নিয়ে ওই আশ্রয় প্রকল্পের ঘরে বাস করতেন। নদীর পানি শনিবার রাতে হঠাৎ ঘরে ঢুকে পড়ে। তাঁরা জিনিসপত্র, চাল–ডাল কিছুই নিতে পারেননি। কোনো রকমে প্রাণ নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছেন।

আরেক বাসিন্দা আবদুল হাকিম মিয়া বলেন, ‘সরকার ঘরগুলা উঁচা জাগাত করি না দিয়া দেছে নদীর নিচা চরোত। এ্যালা ঘরোতে এক বুক পানি। ফায়ার সার্ভিস না আসলে হামাক ঘরোত পানিতে মইরবার নাগিল হয়।’

ওই আশ্রয়ণ প্রকল্পে বাস করতেন শান্তি বালা (৪০)। তিনি স্বামীসহ তিন সন্তান নিয়ে সেখানে থাকতেন। শান্তি বালা বলেন, ‘নদীর পানি হঠাৎ ঘরে ঢুকে পড়েছে। আমি বাড়ির কোনো জিনিসপত্র ঘর থেকে বের করতে পারিনি। ঘরে সব রেখে জীবন নিয়ে বেঁচে এসেছি। মনে হয় সব জিনিস নদীতে ভেসে গেছে।’

শান্তি বালা আরও বলেন, ‘সরকার থাকি প্রথম দিন সন্ধ্যায় মুড়ি পাইছি। এখন এক বেলা ভাত, আরেক বেলা খিচুড়ি পাচ্ছি। এসব খেয়ে সন্তান নিয়ে স্কুলে বেঁচে আছি।’

আরেক বাসিন্দা খাদিমুল ইসলাম বলেন, ‘ঘরোত নদীর পানি হড়হড় করি যখন ঢুকছে, তখন তিনটা ছইল নিয়া মহাবিপদোত পড়ছেনো। ফায়ার সার্ভিস থাকি লোক আসিয়া হামাক উদ্ধার করছে।’

ওই এলাকার বাসিন্দা হবিবর রহমান বলেন, জেনেশুনে নদীর চরে আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘর নির্মাণ করা ঠিক হয়নি। উঁচু জায়গায় ঘরগুলো করা হলে প্রকল্পের বাসিন্দাদের এত দুর্ভোগ পোহাতে হতো না।

দামোদরপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শেখ আবু বক্কর সিদ্দিক বলেন, ‘আমি চেয়ারম্যান হওয়ার আগেই সেখানে আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘরগুলো নির্মাণ করা হয়। তবে নদীর চরে নিচু জায়গায় ওই ঘরগুলো নির্মাণ করা ঠিক হয়নি। সেখানকার বাসিন্দাদের সরিয়ে স্কুলে রাখা হয়েছে। প্রশাসনের পক্ষ থেকে তাদের দুই বেলা খাবারের ব্যবস্থা করা হয়েছে।’

ওই ঘর নির্মাণ কমিটির সদস্যসচিব উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা (পিআইও) বাবুল চন্দ্র রায় বলেন, ‘আমি নদীর চরে ওই ঘর নির্মাণের পক্ষে ছিলাম না। কিন্তু তৎকালীন ইউএনও সেখানে ঘর নির্মাণ করেছেন।’

ইউএনও আবু সাঈদ বলেন, ‘আমি এখানে যোগদানের আগে আবাসন প্রকল্পের ঘর নির্মাণ করা হয়েছিল। বর্তমানে ঘরগুলো পানিতে ডুবে আছে। বাসিন্দাদের স্কুলে সরিয়ে নিয়ে প্রশাসনের পক্ষ থেকে চাল-ডাল দিয়েছি। সার্বক্ষণিক তাদের খোঁজখবর নেওয়া হচ্ছে।’