কক্সবাজার সমুদ্র উপকূলে ডুবন্ত ট্রলার থেকে ১০ জনের অর্ধগলিত লাশ উদ্ধারের সাড়ে ৪ মাস পেরোলেও তদন্ত শেষ করতে পারেনি পুলিশ।
তবে এ ঘটনায় হওয়া মামলায় গ্রেপ্তার ৯ আসামিকে জিজ্ঞাসাবাদ, আদালতে দেওয়া ৬ জনের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি পর্যালোচনা ও অনুসন্ধান চালিয়ে পুলিশ মোটামুটি নিশ্চিত হয়েছে যে সাগরে মাছ ধরার ট্রলারে লুটপাট (ডাকাতি) চালাতে গিয়ে ডুবে যাওয়া ট্রলারের ১০ ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে। নিহত ব্যক্তিরা সবাই ভাড়াটে। তাঁদের ট্রলারটিকে ডাকাতি করতে সাগরে পাঠিয়েছিলেন মহেশখালীর সোনাদিয়া এলাকার জলদস্যু খাইরুল বশর ওরফে সুমন। ডাকাতির কাজে সহযোগিতা করেন মহেশখালী পৌরসভার ৯ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর খায়ের হোসেন।
কক্সবাজার সদর মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেছেন, চাঞ্চল্যকর এই হত্যা মামলার তদন্ত প্রায় শেষ পর্যায়ে। শিগগিরই আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করা হবে।
পুলিশ জানায়, ৬ সেপ্টেম্বর রাতে চট্টগ্রাম মহানগরের ইপিজেড এলাকার রেলগেট থেকে খাইরুল বশরকে গ্রেপ্তার করে র্যাব। ৭ সেপ্টেম্বর বিকেলে খাইরুলকে কক্সবাজার সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে হাজির করে পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তিন দিনের রিমান্ডে নেয়। গতকাল রোববার রাতে তাঁর রিমান্ড শেষ হয়।
ওসি মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম বলেছেন, রিমান্ডে জলদস্যু খাইরুল হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছেন, কিন্তু তা গণমাধ্যমে প্রকাশ করা যাবে না। তবে রিমান্ডের আগে পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে খাইরুল স্বীকার করেন, ডুবন্ত ট্রলার থেকে অর্ধগলিত অবস্থায় যে ১০ জনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে, তাঁদের বিভিন্ন জায়গা থেকে তিনি ভাড়া করে আনেন। এরপর ট্রলার নিয়ে তাঁদের (নিহত ব্যক্তিদের) সাগরে ডাকাতি (ট্রলারের মাছ লুট) করতে পাঠান। এর নেপথ্যে অন্য কারও সংশ্লিষ্টতা আছে কি না, সেটিও পুলিশ খতিয়ে দেখছে বলে জানান ওসি।
গত ২৩ এপ্রিল বিকেলে কক্সবাজার শহরের নাজিরারটেক সাগর উপকূলে ডুবন্ত একটি ট্রলার থেকে ১০ জনের অর্ধগলিত মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিস। এ ঘটনায় ২৫ এপ্রিল কক্সবাজার সদর মডেল থানায় চারজনের নাম উল্লেখ করে ও অজ্ঞাতনামা ৫০ থেকে ৬০ জনকে আসামি করে মামলা করেন ডুবন্ত ট্রলারের মালিক মহেশখালীর হোয়ানক ইউনিয়নের বাসিন্দা সামশুল আলমের (নিহত) স্ত্রী রোকিয়া আকতার। মামলায় নাম উল্লেখ থাকা অন্য আসামিরা হলেন—মহেশখালীর মাতারবাড়ীর মো. কামাল হোসেন ওরফে বাইট্যা কামাল, করিম সিকদার, আনোয়ার হোসেন ও বাবুল মাঝি।
মামলার এজাহারে বলা হয়, আসামিদের চারটি ট্রলারের ৫০ থেকে ৬০ জন লোক মিলে সামশুলের ট্রলারটি জিম্মি করে সামশুলসহ অন্যদের গলায় রশি পেঁচিয়ে, হাত-পা রশি ও জাল দিয়ে বেঁধে মারধর করে বোটের মাছ রাখার হিমাগারের ভেতরে আটকে রাখেন। এরপর হিমাগারের ঢাকনায় পেরেক মেরে লাশ গুম করার উদ্দেশ্যে বোটের তলা ছিদ্র করে দেওয়া হয়। এতে বোটটি পানিতে ডুবে যায়। সামশুলের সঙ্গে আসামিদের পূর্বশত্রুতা ছিল বলে মামলায় উল্লেখ করা হয়।
পুলিশের দেওয়া তথ্য মতে, ৯ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সাড়ে চার মাসে চাঞ্চল্যকর এই হত্যা মামলার এজাহারে নাম থাকা ২ জনসহ মোট ৯ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এর মধ্যে ৬ জন কক্সবাজার আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। তাঁরা হলেন—মামলার প্রধান আসামি মহেশখালীর কামাল হোসেন, চট্টগ্রামের বাঁশখালীর বাসিন্দা ফজল কাদের মাঝি ও আবু তৈয়ূব মাঝি, মহেশখালী পৌরসভার ৯ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর খায়ের হোসেন, চকরিয়া উপজেলার বদরখালীর মো. গিয়াস উদ্দিন মুনির ও মহেশখালীর মাতারবাড়ীর সাইরারডেইলের দেলোয়ার হোসেন। তবে গ্রেপ্তার হওয়া মামলার ৪ নম্বর আসামি করিম সিকদার ও ইমাম হোসেন আদালতে জবানবন্দি দেননি।
জবানবন্দি পর্যালোচনা করে তদন্তসংশ্লিষ্ট পুলিশের একজন কর্মকর্তা বলেছেন, নিহত ১০ জনের ট্রলারটি মূলত সাগরে নেমেছিল অন্য মাছ ধরার ট্রলারে লুটপাট চালাতে। একপর্যায়ে ৪ থেকে ৫টি ট্রলারের জেলেরা পিটুনি দিয়ে ১০ জনকে হত্যা করে বরফ রাখার স্থানে আটকিয়ে ট্রলারটি ডুবিয়ে দেন।
আত্মসমর্পণের পর পুরোনো পেশায় খাইরুল
পুলিশ ও স্থানীয় লোকজন জানান, ২০১৭ সালের ১৯ নভেম্বর সোনাদিয়ার শীর্ষ জলদস্যু মোবারক হোসেন ওরফে জাম্বু বাহিনীর সঙ্গে র্যাবের বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন মোবারক। এরপর জাম্বু বাহিনীর নিয়ন্ত্রণ নেন তাঁর ভাগনে আনজু মিয়া। তখন আনজু বাহিনীর সেকেন্ড ইন কমান্ডের দায়িত্ব পালন করেন জলদস্যু খাইরুল বশর ওরফে সুমন। আনজু-খাইরুল সম্পর্কে মামাতো ভাই।
পুলিশ জানায়, ২০১৮ সালের ২০ অক্টোবর মহেশখালীতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানের হাতে ৯৪টি অস্ত্র ও ৭ হাজার ৬৩৭টি গুলি জমা দিয়ে আত্মসমর্পণ করেছিলেন ৬ জলদস্যু বাহিনীর ৪৩ জন সদস্য। এর মধ্যে সোনাদিয়ার খাইরুলও ছিলেন। এরপর সবার সঙ্গে কারাভোগ করে ২০১৯ সালের মে মাসে জামিনে মুক্ত হয়ে আসেন খাইরুল। অন্য জলদস্যুরা স্বাভাবিক জীবন শুরু করলেও খাইরুল পুরোনো পেশায় ফিরে যান।
ট্রলারে ১০ ব্যক্তি হত্যার পেছনে কারা জড়িত, কেন এই হত্যাকাণ্ড, ১০ জনকে হত্যার পর ট্রলার কেন ডুবিয়ে দেওয়া হলো—এসব প্রশ্নের উত্তর খাইরুলের কাছেই আছে বলে জানিয়েছেন কক্সবাজারের একজন পুলিশ কর্মকর্তা। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, রিমান্ডে জলদস্যু খাইরুল ১০ ব্যক্তি হত্যার বিস্তারিত তুলে ধরেছেন। অস্ত্র গোলাবারুদ ও খাদ্যসামগ্রী দিয়ে ৭ এপ্রিল ট্রলারটি তিনি (খাইরুল) সাগরে পাঠানোর কথাও স্বীকার করেন। উদ্দেশ্য ছিল অন্য মাছ ধরার ট্রলারে লুটপাট চালানো। ট্রলারে ছিলেন ওই ট্রলারমালিক নিহত সামশুল আলম মাঝি। ডাকাতির কাজে সহযোগিতা করেন মহেশখালী পৌরসভার কাউন্সিলর খায়ের হোসেন। পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদের একপর্যায়ে হত্যাকাণ্ডের দায় এড়িয়ে খাইরুল বলেন, ‘আমি তাঁদের (নিহত ব্যক্তিদের) সাগরে পাঠিয়েছিলাম ডাকাতি করতে, মানুষ মারতে নয়।’
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা কক্সবাজার সদর মডেল থানার পরিদর্শক দুর্জয় বিশ্বাস বলেন, ডুবন্ত ট্রলারে ১০ ব্যক্তি নিহত হওয়ার ঘটনার মূল হোতা হচ্ছেন এই ডাকাত খাইরুল বশর। ঘটনার পর থেকেই তিনি আত্মগোপন করেছিলেন। তথ্যপ্রযুক্তি কাজে লাগিয়ে ৬ সেপ্টেম্বর রাতে তাঁকে চট্টগ্রাম মহানগরের একটি আস্তানা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। হত্যা মামলার গ্রেপ্তার অপর ৮ আসামির সবাই কক্সবাজার জেলা কারাগারে।