দুই বন্ধুর ঘুরে দাঁড়ানোর গল্প

নাটোরের গুরদাসপুরের আব্দুর রাজ্জাক ও আব্দুল কুদ্দুসের ভ্রাম্যমাণ হাঁসের খামার। সম্প্রতি চলনবিলের বিলশাহ এলাকায়
ছবি: প্রথম আলো

একসময় যৌথভাবে চাল ও রসুনের ব্যবসা করতেন দুই বন্ধু আবদুর রাজ্জাক ও আবদুল কুদ্দুস। কিন্তু ব্যবসায় লোকসান হওয়ায় পথে বসেন তাঁরা। তখন সংসার চালানো কঠিন হয়ে পড়ে তাঁদের। পুঁজিসংকটের কারণে আবদুল কুদ্দুস অন্যের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের সহযোগী হিসেবে কাজ শুরু করলেও আবদুর রাজ্জাক স্বল্প পুঁজিতে বাড়িতেই হাঁস পালন শুরু করেন। এটি তিন বছর আগের কথা।

এখন দুই বন্ধু যৌথভাবে হাঁসের খামার গড়েছেন। সেখানে ১ হাজার ৬০০টি হাঁস রয়েছে। প্রতিদিন মিলছে এক হাজার ডিম। প্রতি মাসে ডিম বিক্রি করে আয় হচ্ছে ৩ লাখ ৯০ হাজার টাকা। সব খরচ বাদে তাঁদের মাসিক গড় আয় ২ লাখ ২০ হাজার টাকা। সেখানে চারজন শ্রমিক কাজ করছেন মাসিক বেতনে। ভ্রাম্যমাণ হাঁসের খামার গড়ে সচ্ছলতা ফিরেছে তাঁদের সংসারে। পরিবারের সদস্যদের নিয়ে তাঁদের দিন কাটছে আনন্দে।

আবদুর রাজ্জাক ও আবদুল কুদ্দুসের বাড়ি নাটোরের গুরুদাসপুর পৌরসভার পারগুরুদাসপুর খলিফাপাড়ায়। তাঁদের খামার উপজেলার চলনবিল বেষ্টিত রুহাই ও কুন্দইল এলাকায়। হাঁসের দলগুলো বিলের উন্মুক্ত জলরাশিতে দিনভর বিচরণ করে শামুক-ঝিনুক, ছোট মাছ লতাগুল্ম খেয়ে ডিম দিচ্ছে।

এ বিষয়ে আবদুর রাজ্জাক ও আবদুল কুদ্দুস বলেন, প্রাকৃতিক পরিবেশে হাঁসগুলোর ভেসে বেড়ানোর কারণে খাদ্যের খরচসহ রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়ার প্রবণতা কমেছে। ভালো খাবার খাওয়ায় হাঁসগুলো বেশি ডিম দিচ্ছে।

নাটোরের গুরদাসপুরের আব্দুর রাজ্জাক ও আব্দুল কুদ্দুসের ভ্রাম্যমাণ হাঁসের খামার। সম্প্রতি চলনবিলের বিলশাহ এলাকায়
ছবি: প্রথম আলো

হাঁসের খামারটির মূল উদ্যোক্তা আবদুর রাজ্জাক জানান, ব্যবসায় ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পর তাঁর স্ত্রীর পরামর্শে একটি বেসরকারি সংস্থা (এনজিও) থেকে ৫০ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে বাড়িতেই বাচ্চা হাঁস দিয়ে খামার শুরু করেন। দুই বছরেই লাভের মুখ দেখতে শুরু করেন তিনি। কিন্তু বন্ধু আবদুল কুদ্দুসের আর্থিক অবস্থার পরিবর্তন হচ্ছিল না।
গত বছর বন্ধু আবদুল কুদ্দুসকে বুঝিয়ে হাঁসের খামারের সঙ্গে যুক্ত করেন তিনি। পরে দুই বন্ধু মিলে চার লাখ টাকা বিনিয়োগে সম্প্রসারণ করেন খামার। হাঁসের সংখ্যা বৃদ্ধি, পরিচর্যার জন্য মাসিক বেতনে চারজন শ্রমিক নিয়োগ দেন তাঁরা। তাঁরাই এলাকার নদ-নদী, পুকুর-জলাশয়ে হাঁসের দল নিয়ে ঘুরে বেড়ান।

হাঁসের খামার দিয়ে সংসারে সুদিন ফিরিয়ে আনতে সহায়তা করায় বন্ধু আবদুর রাজ্জাকের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে আবদুল কুদ্দুস বলেন, একটা সময় তাঁর প্রতিষ্ঠানে অনেক শ্রমিক কাজ করেছেন। কিন্তু দেশে বিশেষ পরিস্থিতিতে (কোভিড-১৯) ব্যবসায়িক ক্ষতির মুখে পড়ে নিজেই শ্রমিক হয়েছিলেন। এটা ছিল দুঃখ ও বেদনার। কিন্তু বন্ধু রাজ্জাকের উদ্ভাবিত হাঁসের খামারের উদ্যোগে সেই পরিস্থিতি থেকে ঘুরে দাঁড়িয়েছেন তাঁরা। এখন তাঁদের দেখাদেখি চলনবিলজুড়ে কমপক্ষে ১৫টি ভ্রাম্যমাণ হাঁসের খামার গড়ে উঠেছে। খামার করে লাভবান হচ্ছেন সবাই।

ভ্রাম্যমাণ হাঁসের খামার গড়ে তোলার কারণে জানতে চাইলে ওই দুই বন্ধু বলেন, চলনবিলের মাঝ দিয়ে প্রবাহিত দু–একটি নদীতে বছরজুড়েই পানি থাকে। তখন খামারের হাঁসগুলো সেখানে নিয়ে যাওয়া হয়। আবার আগস্ট-সেপ্টেম্বর মাসে চলনবিলে পানি ঢুকলে সেখানে নেওয়া হয় হাঁসের দল। বাজারে খাদ্যের দাম বেশি থাকায় খরচ বাড়ে। কিন্তু উন্মুক্ত জলাশয়ে হাঁসগুলো ছেড়ে দিলে খাদ্য কম লাগে। প্রাকৃতিক খাবার খাওয়ায় খরচ কমে, ডিমও পাওয়া যায় বেশি।

নতুন খামারিদের উদ্দেশে তাঁদের পরামর্শ, কেউ নতুনভাবে হাঁসের খামার করতে চাইলে এপ্রিল মাসের শুরুতে হাঁসের বাচ্চা কিনে লালনপালন শুরু করতে হবে। তিন মাসের মাথায় জুলাই মাসের মাঝামাঝি এসব হাঁস ডিম দেওয়া শুরু করবে।

খামারি রাজ্জাক ও কুদ্দুস আরও জানান, তাঁদের খামারে চারজন শ্রমিক রয়েছেন। তাঁদের মাসিক বেতন ১৫ হাজার করে ৬০ হাজার টাকা। প্রাকৃতিক খাবার খেলেও ১ হাজার ৬০০ হাঁসের জন্য মাসে ৯০ মণ করে ধান লাগে। তার দাম ৯০ হাজার টাকা। এ ছাড়া ওষুধসহ অন্যান্য খরচ লাগে আরও ২০ হাজার টাকা। সব মিলিয়ে এ খামারে প্রতি মাসে খরচ ১ লাখ ৭০ হাজার টাকা। খামার থেকে প্রতিদিন এক হাজার ডিম পাওয়া যায়। প্রতিটি ডিম ১৩ টাকা করে পাইকারেরা খামার থেকেই কিনে নিয়ে যান। ডিম বিক্রি করে প্রতিদিন ১৩ হাজার হিসাবে মাসে ৩ লাখ ৯০ হাজার টাকা আয় তাঁদের। খরচ বাদে প্রতি মাসে তাঁদের গড় আয় ২ লাখ ২০ হাজার টাকা। ছয় মাস পর্যন্ত হাঁসগুলো ডিম দেবে। পরে মাংস উপযোগী হাঁসগুলো বিক্রি করলেও লগ্নিকৃত টাকার চেয়েও অতিরিক্ত টাকা পাওয়া যাবে।

নাটোরের গুরদাসপুরের আব্দুর রাজ্জাক ও আব্দুল কুদ্দুসের ভ্রাম্যমাণ হাঁসের খামার। সম্প্রতি চলনবিলের বিলশাহ এলাকায় ছবি
ছবি: প্রথম আলো

আবদুর রাজ্জাক ও আবদুল কুদ্দুসের দেখাদেখি উপজেলার চাঁচকৈড় বাজার পাড়ার আবদুল মোতালেব ও খোয়ার পাড়া মহল্লার আবু তালেব বলেন, হাঁসের ডিম এবং হাঁস বিক্রির টাকায় নিজের ভাগ্য বদল করেছেন। দুই বন্ধুর খামার দেখে তাঁরা উৎসাহিত হয়েছেন। ভবিষ্যতে খামারটি আরও বড় করার পরিকল্পনা রয়েছে তাঁদের।

গুরুদাসপুর উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা আলমগীর হোসেন বলেন, চলনবিলের উন্মুক্ত জলরাশিতে হাঁস পালন অধিক লাভজনক। সেখানে প্রাকৃতিক খামার মেলে বেশি। ফলে বেশি ডিম পাওয়া যায়। বর্ষা ঘিরে চলনবিল অঞ্চলে খামারভিত্তিক হাঁস পালনের প্রবণতা বেড়েছে। খামারিদের প্রয়োজন অনুযায়ী প্রতিষেধক. চিকিৎসা ও পরামর্শসেবা দেওয়া হচ্ছে।