নিয়ন্ত্রণহীন ইজিবাইকে যানজট

যানজটের দুর্ভোগ লাঘবে পৌর কর্তৃপক্ষ ও স্থানীয় প্রশাসন ব্যর্থ বলে অভিযোগ শহরবাসীর।

ইজিবাইক চলাচলে নিয়ন্ত্রণ না থাকায় জামালপুর পৌর শহরে তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়। গতকাল দুপুরে শহরের কথাকলি মার্কেট এলাকায়প্রথম আলো

জামালপুর পৌর শহরে তীব্র যানজটে সকাল থেকে রাত পর্যন্ত প্রতিদিন চরম দুর্ভোগের শিকার হচ্ছে বাসিন্দারা। অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছে শহরবাসী। যানজটের অন্যতম কারণ সরু সড়কে বিশৃঙ্খলভাবে ইজিবাইকের চলাচল। যানজটের দুর্ভোগ লাঘবে পৌর কর্তৃপক্ষ ও স্থানীয় প্রশাসন ব্যর্থ বলে অভিযোগ শহরবাসীর।

লাগামছাড়া ইজিবাইকগুলোর চলাচল, অদক্ষ চালক, যেখানে-সেখানে ইউটার্ন নেওয়া এবং যাত্রী ওঠানো-নামানোর কারণে মাঝেমধ্যেই ঘটছে ছোট–বড় দুর্ঘটনা। প্রাণহানির ঘটনাও ঘটছে।

শহরের কেন্দ্রীয় বাসস্ট্যান্ড থেকে জেনারেল হাসপাতাল পর্যন্ত প্রায় তিন কিলোমিটার এলাকায় জামালপুর শহর। গত বৃহস্পতিবার ও গতকাল শনিবার সরেজমিন দেখা যায়, সড়কের সব জায়গাই ইজিবাইকের জটলা। ফলে সড়কে কিছু দূর পরপর যানজটের সৃষ্টি হচ্ছে। যানজটে আটকা পড়ে অনেকে হেঁটেই যাওয়ার চেষ্টা করছেন। সবচেয়ে বেশি যানজট লক্ষ করা যায় শহরের দয়াময়ী, বুড়ির দোকান মোড়, কথাকলি মার্কেট, তমালতলা, সকাল বাজার, ঢাকাইপট্টি, বকুলতলা, রেলগেটপার, শফি মিয়ার বাজার মোড়, শহীদ হারুন সড়ক মোড়, ফৌজদারি, জজকোর্ট ও জেনারেল হাসপাতাল এলাকায়। এসব স্থানে ৩০ থেকে ৪০ মিনিট করে যানজটে আটকা পড়েন যাত্রীরা।

জরুরি প্রয়োজনে জেলা প্রশাসনের কার্যালয়ে যাচ্ছিলেন শহরের বাইপাস এলাকার বাসিন্দা মধ্য বয়সী হামিদুর রহমান। যানজটে বসে এ প্রতিবেদককে বলেন, ১২ থেকে ১৪ বছর ধরে শহরবাসী তীব্র যানজটে দুর্ভোগের শিকার হচ্ছেন। এই শহর এখন ইজিবাইকের শহরে পরিণত হয়েছে। ইজিবাইকগুলোর মধ্যে কোনো ধরনের শৃঙ্খলা নেই। ইজিবাইক সড়কে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে।

তমালতলা এলাকার মো. রাকিবুল হাসান নামের একজন প্রথম আলোকে বলেন, শহরের ব্যাপক উন্নয়ন হচ্ছে। কিন্তু এই ইজিবাইকের অসহনীয় যানজট আর সড়কে বের হওয়ার পর, উন্নয়নের সব ছোঁয়া যেন সাধারণ মানুষের কাজে আসছে না। জরুরি কোনো প্রয়োজন ছাড়া বের হই না। সড়কে বের হওয়া মানেই তীব্র যানজটে কষ্ট করা। বছরের পর বছর ধরে এই কষ্ট করতে হচ্ছে।

ইজিবাইকচালকেরা খুব দরিদ্র। বেশি কঠোর হলেই তাঁরা কান্নাকাটি করে। ফলে ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না।
মো.ফজলু আকন্দ, প্যাানেল মেয়র, জামালপুর পৌরসভা

শহরের যানজটের বিষয়টি নজরে আনা হলে জামালপুর ট্রাফিক পুলিশের পরিদর্শক আবদুর রহিম প্রথম আলোকে জানান, সম্প্রতি ইজিবাইক নিয়ন্ত্রণে আইনশৃঙ্খলা কমিটির সভায় সিদ্ধান্ত হয়েছে। যানজট নিয়ন্ত্রণে রাখতে এক দিন লাল ও এক দিন সবুজ ইজিবাইক চলাচল করবে। তিনি বলেন, ‘সিদ্ধান্ত অনুযায়ী এক দিন লাল ও আরেক দিন সবুজ ইজিবাইক চলাচলে কাজ করছি। কিন্তু কোনোভাবেই এটা নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। এক সঙ্গেই দুই রঙের ইজিবাইকই চলাচল করে। তখন আমরা অভিযান চালিয়ে ইজিবাইক আটক করি এবং জরিমানা করা হয়। ইজিবাইক নিয়ন্ত্রণে ট্রাফিক বিভাগ কাজ করছে।’

শহরের ব্যস্ততম দয়াময়ী থেকে বকুলতলা পর্যন্ত প্রায় এক কিলোমিটার সড়কের যানজট অসহনীয়। এ এলাকায় বড় বড় কাপড়ের দোকান, জুতা স্যান্ডেলসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দোকান রয়েছে। সে কারণে সকাল ৯টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত ভিড় লেগে থাকে ওই এলাকাতে। এই সড়কে যানজট লেগে থাকে সব সময়। শহরের প্রধান এ সড়কটি সরু। এ ছাড়া দোকানপাটের কারণে লোকজনের ভিড় থাকে। অনেকে দোকানের সামনে গাড়ি দাঁড় করিয়ে কেনাকাটা করেন। ফলে স্বস্তি নিয়ে চলাচল করা দায়।

জামালপুর পৌরসভা কার্যালয় ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, জামালপুর পৌর শহরে ২০১০ সাল থেকে ইজিবাইক চলাচল শুরু হয়। গত ১৪ বছরে ইজিবাইকের সংখ্যা প্রায় ১১ হাজার। ২০১৮ সালে সিদ্ধান্ত হয়, পৌরশহরে লাইসেন্স করা ৩ হাজার ইজিবাইক চলাচল করবে। সেই লক্ষ্যে পৌর কর্তৃপক্ষ তিন হাজার ইজিবাইকের লাইসেন্স দেয়। গত ছয় বছরে পৌরসভা কর্তৃপক্ষ আরও ১ হাজার ইজিবাইকের লাইসেন্স দিয়েছে। সব মিলিয়ে বর্তমানে ৪ হাজার ইজিবাইকের লাইসেন্স দেওয়া হয়েছে। তবে অবৈধ বাকি ৭ হাজার ইজিবাইক শহরে চলাচল বন্ধ করতে পারেনি পৌর কর্তৃপক্ষ। ফলে এখনো পুরো শহরে প্রায় ১১ হাজার ইজিবাইক চলাচল করছে।

পৌরসভা কর্তৃপক্ষ প্রতিবছর প্রতিটি ইজিবাইক থেকে নিবন্ধনবাবদ সাড়ে ৩ হাজার করে টাকা নেয়। নিবন্ধিত ইজিবাইকগুলোকে প্রতিবছর সাড়ে ৩ হাজার টাকা দিয়ে নতুন নিবন্ধন নিতে হয়। পৌর কর্তৃপক্ষের হিসাবেই বছরে শুধু ইজিবাইক থেকে নেওয়া হচ্ছে ১ কোটি ৪০ লাখ টাকা। এরপরও এসব ইজিবাইক নিয়ন্ত্রণে পৌরসভা কর্তৃপক্ষের নেই উদ্যোগ।

সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলন জামালপুর জেলা শাখার সভাপতি জাহাঙ্গীর সেলিম বলেন, টানা ১৪ বছর ধরে পুরো শহরবাসীর গলার কাঁটা ইজিবাইক। পৌর শহর এখন যানজটের নগরীতে পরিণত হয়েছে। প্রভাবশালীদের ইন্ধনে ফুটপাত দখল, দুর্বল ও সীমিত ট্রাফিক ব্যবস্থা, চাঁদাবাজি এবং অপরিকল্পিত ড্রেনেজ ব্যবস্থাসহ নানা কারণে শহরে যানজট ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে।

জামালপুর পৌরসভার প্যানেল মেয়র মো.ফজলু আকন্দ প্রথম আলোকে বলেন, শুধু ইজিবাইকের কারণে শহরের যানজট নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। ইজিবাইক নিয়ন্ত্রণে অনেক কিছুই করা হয়েছে। ইজিবাইকচালকেরা খুব দরিদ্র। বেশি কঠোর হলেই তাঁরা কান্নাকাটি করে। ফলে ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না।