টেকনাফ ছাড়ল মিয়ানমারের প্রতিনিধিদল, প্রত্যাবাসন নিয়ে সন্দিহান রোহিঙ্গারা

ইউএনএইচসিআরের ব্যবস্থাপনায় প্রতিনিধিদলের সদস্যরা মিয়ানমার ফিরে যাওয়ার কথা থাকলেও শেষ পযন্ত কাঠের বোটেই টেকনাফ ছাড়েন তাঁরা। আজ বুধবার সকালে টেকনাফের নাফনদীর ট্রানজিট ঘাটে
ছবি: প্রথম আলো

৪৮০ রোহিঙ্গার তথ্য যাচাই শেষে মিয়ানমারের প্রতিনিধিদল কক্সবাজারের টেকনাফ ছেড়েছেন। আজ বুধবার সকালে প্রতিনিধিদলটি কাঠের ট্রলারে চড়ে টেকনাফ থেকে রাখাইন রাজ্যের মংডুতে ফিরে গেছেন। এর আগে গত সাত দিনে ১৭৭ পরিবারের ৪৮০ জন রোহিঙ্গার তথ্য যাচাই সম্পন্ন করেছে প্রতিনিধিদলটি।

তবে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন কিংবা টেকনাফে এসে রোহিঙ্গা তথ্য যাচাই নিয়ে কোনো মন্তব্য করেননি প্রতিনিধিদলের সদস্যরা। এদিকে প্রত্যাবাসন নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করছেন রোহিঙ্গারা। তাঁদের দাবি, শিগগিরই প্রত্যাবাসন শুরুর মতো কোনো পরিবেশ তৈরি হয়নি।

১৫ মার্চ মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের মংডু থেকে দ্রুতগতির কয়েকটি জলযানে চড়ে মিয়ানমারের ২২ সদস্যের প্রতিনিধিদলটি টেকনাফে আসে। মিয়ানমার থেকে নাফ নদী অতিক্রম করে টেকনাফ আসার জন্য জলযানের ব্যবস্থা করে জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক সংস্থা (ইউএনএইচসিআর)। একই ব্যবস্থাপনায় প্রতিনিধিদলের সদস্যরা মিয়ানমার ফিরে যাওয়ার কথা থাকলেও শেষ পযন্ত কাঠের বোটেই টেকনাফ ছাড়েন দলের সদস্যরা।

এদিকে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের পরিস্থিতি রোহিঙ্গা শরণার্থীদের টেকসই প্রত্যাবর্তনের জন্য অনুকূল নয় বলে মনে করছে ইউএনএইচসিআর। সেখানকার পরিস্থিতি মূল্যায়নের পর তিন দিন আগে এই মন্তব্য করেছে সংস্থাটি। ইউএনএইচসিআরের পক্ষ থেকে এটাও বলা হয়েছে, রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সম্ভাব্য প্রত্যাবাসনের বিষয়ে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের আলোচনায় তারা জড়িত নয়।

এ প্রসঙ্গে শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার (আরআরআরসি) মোহাম্মদ মিজানুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, রোহিঙ্গাদের তথ্য যাচাইয়ে ইউএনএইচসিআরের ব্যবস্থাপনায় মিয়ানমারের প্রতিনিধিদলটি টেকনাফ এসেছিল। সাত দিনে ১৭৭ পরিবারের ৪৮০ জন রোহিঙ্গার তথ্য যাচাই সম্পন্ন করা হয়েছে। তবে প্রতিনিধিদলের সদস্যদের মিয়ানমার ফিরে যাওয়ার জন্য ইউএনএইচসিআর কেন জলযান দিল না, সে বিষয়ে তিনি কিছু জানেন না।

আরও পড়ুন

রোহিঙ্গা তথ্য যাচাই নিয়ে প্রতিনিধিদলের পর্যবেক্ষণ কী ছিল, জানতে চাইলে আরআরআরসি মিজানুর রহমান বলেন, ‘রোহিঙ্গা তথ্য যাচাই শেষে আমরা ওদের (মিয়ানমার প্রতিনিধিদল) কাছে জানতে চেয়েছিলাম, ‘ফাইন্ডিং কী’। তবে ফাইন্ডিং নিয়ে প্রতিনিধিদলের সদস্যরা আমাদের কাছে কোনো ধরনের মন্তব্য করতে রাজি হননি।’

আরআরআরসি কার্যালয় সূত্র জানায়, চীনের মধ্যস্থতায় ২০২২ সালের জানুয়ারি মাসে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরুর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। তখন প্রত্যাবাসনের জন্য বাংলাদেশ থেকে যে আট লাখ রোহিঙ্গার তালিকা মিয়ানমারে পাঠানো হয়েছিল, তার মধ্যে থেকে পাইলট প্রকল্পের আওতায় প্রথম ধাপে ১ হাজার ১৪০ জন রোহিঙ্গাকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। এর মধ্যে ৭১১ জন রোহিঙ্গাকে প্রত্যাবাসনে মিয়ানমারের সম্মতি পাওয়া গিয়েছিল। অবশিষ্ট ৪২৯ জন রোহিঙ্গার বিষয়ে মিয়ানমারের অপত্তি ছিল।

বাংলাদেশ সরকারের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে মিয়ানমারের প্রতিনিধিদলটি টেকনাফে এসেছে ৪২৯ জন রোহিঙ্গার সাক্ষাৎ এবং তথ্য যাচাইয়ে। গত সাত দিনে ৪২৯ রোহিঙ্গার তথ্য যাচাইয়ের পাশাপাশি তাঁদের পরিবারে জন্ম নেওয়া আরও ৫১ জন শিশুর তথ্য সংগ্রহ করে তারা। বাংলাদেশের আশ্রয়শিবিরে এসব শিশুর জন্ম হয়েছে।

প্রত্যাবাসন নিয়ে সন্দিহান রোহিঙ্গারা

গত সাত দিনে মিয়ানমারের প্রতিনিধিদলের মুখোমুখি হয়েছে টেকনাফের শানবন, জাদিমোরা ও লেদা আশ্রয়শিবিরের অন্তত ১৫২ জন রোহিঙ্গা। এর মধ্যে একাধিক রোহিঙ্গা ধারণা করছেন, শিগগিরই রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরু হবে না। কারণ, প্রত্যাবাসন শুরু করার মতো পরিবেশ মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে নেই।

কয়েকজন রোহিঙ্গা নেতা বলেন, চীনের চাপে মিয়ানমার প্রত্যাবাসন শুরু করার জন্য অল্পসংখ্যক রোহিঙ্গার তথ্য যাচাই করতে টেকনাফে প্রতিনিধিদল পাঠালেও এর সঙ্গে ইউএনএইচসিআরকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। এ ছাড়া কয়েক দিন আগে ইউএনএইচসিআর বিবৃতি দিয়ে জানিয়েছে, রাখাইন রাজ্যের পরিস্থিতি রোহিঙ্গা শরণার্থীদের টেকসই প্রত্যাবর্তনের জন্য অনুকূল নয়। এমন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ থেকে জোর করে রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানো হলে বিশ্বব্যাপী প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হবে।

গতকাল মঙ্গলবার টেকনাফ স্থলবন্দরের মালঞ্চ সম্মেলনকক্ষে মিয়ানমার প্রতিনিধিদলের কাছে সাক্ষাৎ দেন ১৮ পরিবারের ২৭ জন রোহিঙ্গা। তাঁদের একজন নজির আহমদ (৪৪) বলেন, কমিটির সদস্যরা জানতে চেয়েছিলেন—তাঁর বাড়ি রাখাইন রাজ্যের কোন গ্রামে, সেখানকার ইউপি চেয়ারম্যানের নাম কী, রাখাইনে থাকতে পরিবারে কয়জন সন্তান ছিল, বাংলাদেশের আশ্রয়শিবিরে কতজন সন্তান জন্ম নিয়েছে, মিয়ানমারে ফিরতে রাজি কি না? সব প্রশ্নের উত্তর দেওয়া শেষে কাগজে স্বাক্ষর অথবা টিপসই নেওয়া হয়। কমিটির সদস্যরা তাঁদের ছবিও তুলেছেন। তবে প্রতিনিধিদলের সদস্যরা রোহিঙ্গাদের কোনো প্রশ্নের জবাব দেননি বলে দাবি করেন তিনি।

টেকনাফের জাদিমোরা আশ্রয়শিবিরের রোহিঙ্গা গফুর আলম (৫১) বলেন, সাক্ষাৎকারটি তাঁর কাছে লোকদেখানো মনে হচ্ছে। আগামী ২৪ এপ্রিল আন্তর্জাতিক আদালতে (আইসিজে) মিয়ানমারের জান্তা সরকারের গণহত্যা মামলায় বক্তব্য উপস্থাপন করার কথা রয়েছে। এর আগে কয়েক শ রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশ থেকে রাখাইন রাজ্যে ফিরিয়ে নিয়ে গণহত্যার মতো বর্বর ঘটনাকে ভিন্ন খাতে নেওয়া চক্রান্ত চলছে। রোহিঙ্গারা কাউকে এই সুযোগ নিতে দেবে না। আগে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব দিতে হবে, তারপর রোহিঙ্গারা রাখাইনে ফিরে যাবে। রাখাইন রাজ্যের কোনো আশ্রয়শিবিরে বন্দিজীবন কাটাতে রাজি নন তাঁরা।

তবে রোহিঙ্গা তথ্য যাচাইয়ের এই উদ্যোগ বিফলে যাবে না, জানিয়ে আরআরআরসি মিজানুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ১০ লাখ রোহিঙ্গাকে প্রত্যাবাসনের বিষয়টি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া, এটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা না। একবার প্রত্যাবাসন শুরু হলে, একটা সময় সবাইকে ফিরে যেতে হবে। তবে প্রত্যাবাসন হতে হবে সম্মানের সঙ্গে স্বেচ্ছায় এবং টেকসইমূলকভাবে। ইচ্ছার বিরুদ্ধে কোনো রোহিঙ্গাকে প্রত্যাবাসনের সুযোগ নেই।

বর্তমানে উখিয়া ও টেকনাফের ৩৩টি আশ্রয়শিবিরে নিবন্ধিত রোহিঙ্গার সংখ্যা সাড়ে ১২ লাখ। এর মধ্যে ৮ লাখ এসেছেন ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পর, দেশটির নিরাপত্তা বাহিনীর নিপীড়নের মুখে। তবে দীর্ঘ সাড়ে পাঁচ বছরেও একজন রোহিঙ্গাকে মিয়ানমার ফেরত পাঠানো সম্ভব হয়নি।