জেলার রাজনীতি—৯: রংপুর
ঘাঁটিতে স্বস্তিতে নেই জাতীয় পার্টি, কমিটিহীন আ.লীগ, মামলার চাপে বিএনপি
গত সিটি নির্বাচনে দলীয় প্রার্থীর পরাজয়ে বড় ধাক্কা খেয়েছে আওয়ামী লীগ। এরপরই দলের জেলা ও মহানগর কমিটি ভেঙে দিয়ে আহ্বায়ক কমিটি করে কেন্দ্র।
রংপুরকে জাতীয় পার্টির (জাপা) ঘাঁটি বলা হয়। টানা ৯ বছর রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকা দলটির প্রতিষ্ঠাতা এইচ এম এরশাদের বাড়ি রংপুরে। সর্বশেষ রংপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে জাপার প্রার্থী মোস্তাফিজার রহমান বিপুল ভোটে বিজয়ী হয়েছেন। যদিও জাপার অবস্থা আগের মতো আর নেই বলেই মনে করেন স্থানীয় অনেক নেতা। একসময় জেলার সব কটি আসন জাপার দখলে থাকলেও এখন আছে মাত্র দুটি। সাংগঠনিকভাবেও দলটি তেমন গোছানো নয়।
টানা তিন মেয়াদে ক্ষমতায় থাকার ফলে রংপুরে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক ভিত্তি শক্ত হয়েছে। ১৫ বছরে তৃণমূলে জাপা যেখানেই দুর্বল হয়েছে, সেখানেই আওয়ামী লীগ অবস্থান শক্ত করেছে। গত সিটি নির্বাচনে দলীয় প্রার্থীর পরাজয়কে দলের পরাজয় মানতে নারাজ জেলা আওয়ামী লীগের নেতারা। প্রার্থী নির্বাচন সঠিক না হওয়ায় ভরাডুবি হয়েছে বলে তাঁদের দাবি।
সরকারের দমন-পীড়নে রংপুরের রাজনীতিতে বিএনপি খুব একটা সুবিধা করতে পারছে না। নেতা-কর্মীরা বর্তমানে কেবল কেন্দ্রীয় কর্মসূচিগুলো পালন করছেন। দলীয় কার্যালয়ের সামনে থেকে আধা কিলোমিটারের মধ্যে দলের সভাসমাবেশ ঘুরপাক খাচ্ছে।
সিটি নির্বাচনে জয়ে চাঙা জাপা
জেলার ছয়টি আসনে মাত্র দুজন সংসদ সদস্য জাপার। এর মধ্যে একটি রংপুর-১ (গঙ্গাচড়া-সদরের একাংশ), আরেকটি রংপুর-৩ (সদর)। বাকি চারটি আসন এখন আওয়ামী লীগের দখলে। দলের সাবেক মহাসচিব রংপুর-১ আসনের সংসদ সদস্য মসিউর রহমান রাঙ্গা। তাঁকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। রংপুর-৩ আসনের সংসদ সদস্য এরশাদ-পুত্র রাহগির আল মাহি এরশাদ (সাদ এরশাদ)। শহরকেন্দ্রিক রাজনীতির মধ্যে ঘুরপাক খাওয়া জাপার জেলা ও মহানগরে পূর্ণাঙ্গ কমিটি নেই। আট উপজেলারও একই চিত্র। ১৫ সেপ্টেম্বর রংপুরে দুই দিনের সফরে এসে দলের চেয়ারম্যান জি এম কাদের নেতা-কর্মীদের বলেন, দলকে গতিশীল করতে বিভিন্ন জেলা-উপজেলায় সম্মেলনের মাধ্যমে কমিটি গঠন চলছে। আসন্ন সংসদ নির্বাচনের জন্যও প্রস্তুতি আছে।
চলতি বছর ২৭ ফেব্রুয়ারি সিটি নির্বাচনে বিপুল ভোটে জাপার প্রার্থী মোস্তাফিজার রহমান জয়লাভ করার পর দল মনে করা হয়েছিল জাপা নতুন করে চাঙা হয়ে উঠবে। তবে এই জয়ের পেছনে শুধু দল নয়, ব্যক্তি মোস্তাফিজারের ভাবমূর্তি প্রভাবক ছিল। মোস্তাফিজারই এখন রংপুরে জাতীয় পার্টির ভরসা বলে দলের নেতা-কর্মীরা মনে করেন।
বিদেশে অবস্থান করা মোস্তাফিজার রহমান গত বৃহস্পতিবার সকালে হোয়াটসঅ্যাপে প্রথম আলোকে বলেন, এখন নির্বাচনের সময়, দলের কমিটি নিয়ে ভাবার সময় নেই। বরং নির্বাচনে অংশ নিয়ে সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড জোরালোভাবে করতে পারলেই দল গোছানোর কাজও হয়ে যাবে। দলের নাজুক পরিস্থিতি প্রসঙ্গে মেয়র বলেন, ‘ইতিপূর্বে যাঁরা রংপুরের বিভিন্ন আসনে সংসদ সদস্য ছিলেন, তাঁরা মূলত দলের জন্য কাজ করেননি। এ কারণে দলকে টিকিয়ে রাখাও কষ্টকর হয়ে উঠেছে।’
সদর আসনের সংসদ সদস্য সাদ এরশাদের রংপুরে উপস্থিত না থাকাও দলের বড় ক্ষতি হয়েছে, এমন মন্তব্য করে মোস্তাফিজার বলেন, ‘এবার নির্বাচনে সদর আসনে দলের চেয়ারম্যান জি এম কাদের নির্বাচন করবেন, এমনটাই দাবি। আর যদি তিনি না করেন, তাহলে একজন স্থানীয় নেতার নির্বাচন করা উচিত।’
মসিউর রহমানকে ঘিরে জাপার নেতা-কর্মীদের জল্পনাকল্পনার শেষ নেই। একসময় মসিউর রহমানই রংপুর জেলা জাপার তৃণমূল নিয়ন্ত্রণ করতেন। দল থেকে বহিষ্কার করা হলেও তিনি এখনো দলের এমপি ও সংসদে বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ। গুঞ্জন রয়েছে, আসন্ন সংসদ নির্বাচন ঘিরে মসিউর রহমানের ইস্যু নতুন একটা মোড় নিতে পারে জাপার রাজনীতিতে।
মসিউর রহমান ২০ সেপ্টেম্বর মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাকে বহিষ্কার করা হলেও আমি কিন্তু এখনো জাতীয় পার্টির হয়ে নির্বাচনী এলাকায় কাজ করে যাচ্ছি। দলের কেউই বিরোধিতা করছে না।’ তিনি আরও বলেন, ‘জাতীয় পার্টির হয়েই নির্বাচন করার ইচ্ছে আছে। আমি চাই, মিলেমিশে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করা। সময়ে সব বলে দেবে।’
জাপার কেন্দ্রীয় কমিটির ভাইস চেয়ারম্যান ও রংপুর মহানগর জাপার সদস্যসচিব এস এম ইয়াসির বলেন, মসিউর এখন দলের কেউ নন। মনোনয়ন চাইলে দলের পার্লামেন্টারি বোর্ড বিষয়টি দেখবে। তিনি সদরে মনোনয়ন চাইবেন বলে প্রথম আলোকে জানিয়েছেন। এ আসনে জেলা জাপার সদস্যসচিব আবদুর রাজ্জাকও মনোনয়নপ্রত্যাশী। আর মসিউর রহমানের আসনে প্রার্থী হতে চান সাবেক এমপি ও এরশাদের ভাতিজা আসিফ শাহরিয়ার।
আওয়ামী লীগে প্রার্থিতার দ্বন্দ্ব
গত সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পান হোসনে আরা লুৎফা। তিনি এর আগে সংরক্ষিত আসনের সংসদ সদস্য ছিলেন। নির্বাচনের অনেক আগে থেকে মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি শফিয়ার রহমান ও সাধারণ সম্পাদক তুষার কান্তি মণ্ডল ব্যাপক প্রচারণা চালিয়েছিলেন। নির্বাচনে মাত্র ২২ হাজার ভোট পান হোসনে আরা লুৎফা। জামানতও বাজেয়াপ্ত হয়। এমন পরিস্থিতিতে নির্বাচনের এক দিন পরই কেন্দ্র থেকে জেলা ও মহানগর কমিটি ভেঙে গঠন করা হয় আহ্বায়ক কমিটি। দলীয় নেতা-কর্মীরা জানান, এর পর থেকেই নেতা-কর্মীরা ঝিমিয়ে পড়েন। কিন্তু গত ২ আগস্ট দলীয় প্রধান ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রংপুরে এলে সেই চিত্র বদলে যায়।
রংপুর-৫ (মিঠাপুকুর) আসনের বর্তমান সংসদ সদস্য কেন্দ্রীয় কমিটির কোষাধ্যক্ষ এইচ এন আশিকুর রহমান। প্রভাবশালী এই নেতার এলাকায় চার বছরের বেশি সময় ধরে দলের কোনো কমিটি নেই। তিনি এবার নির্বাচন করবেন না, ছেলে রাশেক রহমানের জন্য মনোনয়ন চাইবেন। বর্তমান উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান জাকির হোসেন ও জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক যুগ্ম সম্পাদক মোতাহার হোসেন মণ্ডল এ আসনে মনোনয়নপ্রত্যাশী।
এইচ এন আশিকুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি তো আমার ছেলের জন্য মনোনয়ন চাইব। অন্যরাও চাইতে পারেন। তবে দলের নেত্রী যাঁকে মনোনয়ন দেবেন, সেটিই হবে চূড়ান্ত।’
পরিস্থিতি অনুকূলের অপেক্ষায় বিএনপি
সরকারের দমন-পীড়ন, গ্রেপ্তার আর ‘গায়েবি’ মামলার কারণে জেলা বিএনপি বিপর্যস্ত। আসন্ন সংসদ নির্বাচনে কেউ প্রকাশ্যে প্রার্থী হওয়ার কথা বলছেন না। নাম প্রকাশ না করার শর্তে জেলার একজন নেতা বলেন, পরিস্থিতি বিএনপির অনুকূলে এলে নির্বাচনের মাঠে তাঁরা নেমে পড়বেন।
দেড় বছর ধরে জেলা ও মহানগর বিএনপি আহ্বায়ক কমিটি দিয়েছে চলছে। সম্মেলন ও পূর্ণাঙ্গ কমিটি না হওয়ায় নেতা-কর্মীদের মধ্যে হতাশা রয়েছে।
জেলা বিএনপির আহ্বায়ক সাইফুল ইসলাম বলেন, চলমান রাজনীতির কারণে সম্মেলন করা সম্ভব হয়ে ওঠেনি। এরপরও আন্দোলনের পাশাপাশি সম্মেলনের চিন্তাভাবনা করা হচ্ছে।
মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক সামসুজ্জামান বলেন, ‘২২টি গায়েবি মামলা আমাদের কাহিল করে ফেলেছে। আমাদের আন্দোলন সফল হলে প্রার্থী বিষয়ে চিন্তাভাবনা করা হবে।’
রংপুরের ছয়টি আসনে বিএনপি থেকে যাঁদের প্রার্থী হওয়ার কথা শোনা যাচ্ছে তাঁরা হলেন রংপুর-১ আসনে গঙ্গাচড়া উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক ওয়াহেদুজ্জামান। রংপুর-২ আসনে সাবেক সংসদ সদস্য মোহাম্মদ আলী সরকার, বদরগঞ্জ পৌর বিএনপির আহ্বায়ক আজিজুল ইসলাম, রংপুর মহানগর বিএনপির সদস্যসচিব মাহফুজ উন নবী ও আইনজীবী গোলাম রসুল।
রংপুর-৩ আসনে মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক সামসুজ্জামান। রংপুর-৪ আসনে শিল্পপতি এমদাদুল হক ভরসা ও আফসার আলী। রংপুর-৬ আসনে জেলা বিএনপির আহ্বায়ক সাইফুল ইসলাম। তবে রংপুর-৫ আসনে কারও নাম জানা যায়নি।