গুড়ের জিলাপির সঙ্গে হরেক পদ

রংপুরের ইফতারিতে গুড়ের জিলাপি তৈরির ঐতিহ্য অন্তত ছয় দশকের। রংপুর নগরের নবাবগঞ্জ বাজারের মুসলিম মিষ্টান্ন ভান্ডারেছবি: মঈনুল ইসলাম

ইফতারে খাবার বলতে গমের ছাতু আর পানি। যাঁদের সামর্থ্য একটু বেশি, তাঁরা হয়তো ছাতুর পাশাপাশি লেবু-চিনির শরবত খেতেন। রংপুরের নবাবগঞ্জ বাজারে মুসলিম মিষ্টান্ন ভান্ডারে গুড়ের জিলাপির চল তখন শুরু হয়েছে। গত শতকের ষাটের দশকে রংপুরের সাধারণ মানুষের ইফতারের আয়োজন ছিল অনেকটা এমন।

পরবর্তী সময়ে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ইফতারিতে যোগ হয় মুড়িমুড়কি, গুড়, পেঁয়াজু আর ছোলা। আর এখন রংপুরের মানুষের ইফতারে যুক্ত হয়েছে দামি রেস্তোরাঁর হরেক পদের খাবার। কিন্তু আগের সেই জিলাপি এখনো রয়ে গেছে ইফতারির ঐতিহ্য হয়ে।

রংপুর শহরের উত্তর কেল্লাবন্দ এলাকার বাসিন্দা বীর মুক্তিযোদ্ধা নূরুল ইসলাম। বয়স ৮০ ছুঁয়েছে তাঁর। স্মৃতি হাতড়ে বললেন, ষাটের দশকে বাইরে থেকে ইফতারি কেনার চল ছিল না। সবার বাড়িতে কমবেশি গম বা ভুট্টার ছাতু ছিল। বাজারেও কিনতে পাওয়া যেত ছাতু। দামেও সস্তা। ছাতু পানির সঙ্গে লবণ মিশিয়ে ইফতারে খাওয়া হতো।

ছাতুর পাশাপাশি শর্ষের তেল মেখে মুড়িমুড়কি দিয়েও ইফতারি দেওয়া হতো আগে। চাল ভেজে পানিতে ফেলা হতো। সেই চাল পেঁয়াজ, লবণ মেখে তেল দিয়ে ‘বিরান’ (বিরিয়ানি) বানিয়ে ইফতারে খাওয়া হতো, এমনটাই জানালেন নূরল ইসলাম।

আগে দোকানে দোকানে দানাদার গুড় বিক্রি হতো। বাড়িতেও বানানো হতো গুড়। সেই গুড়ের সঙ্গে ছাতু আর পানি মিশিয়ে তৈরি হতো মজাদার ইফতারি, বলছিলেন রংপুরের প্রবীণ শিক্ষাবিদ, লেখক ও গবেষক মোহাম্মদ শাহ আলম। তাঁর ভাষায়, বাড়ির গাছের লেবু দিয়ে শরবত বানানো ছিল ইফতারির অবিচ্ছেদ্য অংশ। কমবেশি সব বাড়িতে কলাগাছ ছিল। গাছের কলা পেড়ে ইফতার করা হতো। নিজেদের গাছের মনুয়া, চিনিচাম্পা আর আটিয়া কলা ইফতারের পাতে উঠত।

সময়টা ১৯৬০ সাল। রংপুরের নবাবগঞ্জ বাজারে গুড়ের জিলাপি বানানো শুরু করেন মুসলিম মিষ্টান্ন ভান্ডারের আবুল কাশেম। তিনি মারা যাওয়ার পর জিলাপি বানানো বন্ধ হয়নি। বরং ৬৪ বছর ধরে সুনামের সঙ্গে এখনো জিলাপির ব্যবসা টিকিয়ে রেখেছে মুসলিম মিষ্টান্ন ভান্ডার। ষাটের দশকের শুরুতে প্রতি সের পঁচিশ পয়সায় বিক্রি হতো। আর এখন ২০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে মুসলিম মিষ্টান্নের গুড়ের জিলাপি। বংশপরিক্রমায় চলছে এ ব্যবসা।

এখন ব্যবসা সামলাচ্ছেন প্রয়াত আবুল কাশেমের ছোট ছেলে জাহাঙ্গীর কবির। তিনি বলেন, ‘ইফতারে সেকালের সেই গুড়ের জিলাপির কদর একালেও ফুরিয়ে যায়নি। পবিত্র রমজান মাসে জিলাপির চাহিদা বেশ বেড়ে যায়। বছরের অন্যান্য সময়ের চেয়ে রোজায় জিলাপি বিক্রির পরিমাণ দ্বিগুণের বেশি। দূরদূরান্ত থেকে মানুষ এসে জিলাপি কেনেন। প্রতিদিন চার থেকে পাঁচ মণ জিলাপি বিক্রি হয়।

এখানে জিলাপি কিনতে এসেছিলেন জুম্মাপাড়া এলাকার বাসিন্দা হাফিজুল ইসলাম। তাঁর বয়স ৭৫ বছর। বললেন, ‘একসময় বাঁশের খাঁচায় করে ইফতারি বিক্রি হতো। এখন কাগজের ঠোঙায় ভরে ইফতারি দেয় দোকানগুলো। ইফতারির সঙ্গে এ গুড়ের জিলাপি না থাকলে যেন অপূর্ণ থেকে যায়। তাই প্রতিদিনই এখান থেকে নেওয়া হয় জিলাপি।’

রংপুর নগরীজুড়ে শুধু গুড়ের জিলাপি নয়, বিভিন্ন দোকানে ইফতারির আগে হরেক পদের জিলাপির পসরা সাজিয়ে বসেন বিক্রেতারা। বিক্রি হয় শাহি ও রেশমি জিলাপি। এসব জিলাপির কেজি ৩০০ টাকা। সাধারণ মানের জিলাপি প্রতি কেজি ২০০ টাকায় বিক্রি হতে দেখা যায়।

হরেক পদের ইফতারি নিয়ে বসেছেন বিক্রেতারা
ছবি: প্রথম আলো

ইফতারের ঐতিহ্য নিয়ে স্মৃতিকাতর হন বয়স্করা। তরুণদের কাছে এখন অনেক বিকল্প। নগরীজুড়ে নানা দোকানে হরেক পদের ইফতারি বিক্রি হয়। সাধারণত দুপুরের পর থেকে পাড়া-মহল্লায় দোকানগুলো পসরা সাজিয়ে বসে যায়। নগরীর কাচারিবাজার ও ধাপ এলাকায় ইফতারি বিক্রির সবচেয়ে বড় বাজার।

ইফতারে কোন খাবারের কদর বেশি? এমন প্রশ্ন শুনে কাচারিবাজারের মহুয়া কনফেকশনারির স্বত্বাধিকারী নূরুল হক বললেন, জিলাপি, ছানার পোলাও, বুট, বিরানি বেশি বিক্রি হয়। মুরগির নানা পদের বিক্রিও ভালো। তবে হালিমের বেচাবিক্রিও ভালো হচ্ছে। বাটিভেদে ৫০ থেকে ১০০ টাকায় হালিম বিক্রি হয়।

মেডিকেল মোড়ের পাশের ধাপ এলাকায় বড় বড় কয়েকটি রেস্তোরাঁয় ইফতারের বেশ আগে ক্রেতাদের ভিড় দেখা গেল। এসব রেস্তোরাঁয় গোটা মুরগি দিয়ে বানানো পদের চাহিদা রয়েছে। পাশাপাশি মুরগির রেজালা, গ্রিল, ফ্রাই; ছানার পোলাও, বুন্দিয়া, সাধারণ জিলাপি, শাহি জিলাপি, রেশমি জিলাপি, জালি কাবাব বেশ বিক্রি হচ্ছে।