গাছের ছায়ায় মনমাতানো ‘গোল পুকুর’পাড়ে

সম্প্রতি গাইড ওয়ালসহ পুকুরের সৌন্দর্যবর্ধনের জন্য ব্লক স্থাপন ও পাকা ঘাট নির্মাণ করা হয়েছে। জেলা পরিষদ ও পাবলিক লাইব্রেরি এলাকায়ছবি: প্রথম আলো

একটা সময় প্রায় বাড়িতেই ছিল পুকুর। শহরের বিভিন্ন পাড়ায়, অফিস-আঙিনায়ও ছোট–বড় দু-একটি পুকুরের দেখা মিলেছে। এই পুকুরই ছিল রোজকার পানি ব্যবহারের বড় জোগানদার। অনেক পুকুরেই ছিল শানবাঁধানো ঘাট। সেই দিন আর নেই। মাত্র কয়েক দশকেই এই চেনা দৃশ্যপট বদলে গেছে। প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে সরকারি-বেসরকারি অনেক পুকুরই ভরাট হয়ে গেছে। হাওয়া হয়ে গেছে পুকুরগুলো। তা সত্ত্বেও গ্রামাঞ্চলে কিছু পুকুর বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা আছে। কিন্তু শহরে এই বদলটা হয়েছে অনেক বেশি। তবে এই হারানোর স্রোতেও ঐতিহ্যের নীরব সাক্ষী হয়ে টিকে আছে মৌলভীবাজার শহরের জেলা পরিষদ কার্যালয় এলাকার একটি ‘গোল পুকুর’। ঐতিহ্যবাহী এই পুকুরের সৌন্দর্যে চোখ জুড়িয়ে যায়।

স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আড়াই-তিন দশক আগেও জেলা পরিষদ আঙিনাটি ছিল অন্য রকম। নিচু দেয়ালে ঘেরা স্থানটি ছিল গাছগাছালিতে পরিপূর্ণ। এখানে যেসব ঘর ছিল, তার মধ্যে অন্যতম ছিল লাল টিনের বাংলো ধাঁচের মৌলভীবাজার পাবলিক লাইব্রেরি ভবনটি। দূর থেকেই ভবনটি নজরে পড়ত। তবে পরবর্তী সময়ে টিনের ঘরটি বদলে পুরোদস্তুর পাকা দালান হয়েছে। পাশে জেলা পরিষদের রেস্টহাউস, কার্যালয় ভবন তো আছেই। এসব ভবনের হৃদটুকরো হয়ে আছে একটি পুকুর। যেটি প্রচলিত ধরনের চার কোনা কোনো পুকুর নয়; বরং একটি গোলাকার পুকুর। পুকুরের আকৃতি দেখতে অনেকটা ডিমের মতো। জেলা পরিষদ আঙিনায় যেন ফুসফুস হয়ে আছে পুকুরটি।

স্থানীয় লোকজন বলছেন, প্রায় সারা বছরই কমবেশি এই পুকুরে পানি থাকে। একসময় এই পুকুরে পেশাদার ডুবুরিরা তাঁদের ক্রীড়ানৈপুণ্য প্রদর্শন করেছেন। পুকুরের পাড়ে বর্ষবরণের মতো সর্বজনীন নানা উৎসবে সাংস্কৃতিক আয়োজন করেছে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠন। পাবলিক লাইব্রেরিকে কেন্দ্র করে যাঁরা বই ও পত্রিকা পড়তে আসতেন, তাঁদের অনেকেই একফাঁকে পুকুরের ঘাটে বসে আড্ডা দিয়েছেন। ১৯৬৫ সালে সাহিত্যানুরাগী সরকারি কর্মকর্তা, স্থানীয় শিল্প-সংস্কৃতি ও সাহিত্যের মানুষ মিলে পাবলিক লাইব্রেরিটি গড়ে তোলেন। তবে পাবলিক লাইব্রেরি ভবনটি ছিল পাবলিক লাইব্রেরি গড়ে তোলারও অনেক আগে থেকেই। গোল পুকুরটি ওই ভবনের সমান, নয়তো তার বেশি বয়সের বলেই অনেকের ধারণা।

পুকুরটি কখন, কেন এবং কার সময় বা উদ্যোগে এ রকম গোল করে খনন করা হয়েছিল, সে সম্পর্কে নিশ্চিত করে কিছু জানা যায়নি। তবে এ রকম প্রচারণা আছে, পাবলিক লাইব্রেরি ভবনসহ জেলা পরিষদ কার্যালয় এলাকার অন্যান্য ভবন নির্মাণের সময় ভিটা তৈরির জন্য এই পুকুর খনন করা হয়েছিল। সেই দিক থেকে পুকুরটির বয়স শত বছরের কাছেপিঠে। পুকুরটি সেই থেকে তার সৌন্দর্য নিয়ে টিকে আছে।

পুকুরের মাঝে আছে দৃষ্টিনন্দন ফোয়ারা
ছবি: প্রথম আলো

স্থানটি ঘুরে দেখা গেছে, গোল পুকুরের পাড়জুড়ে বিভিন্ন জাতের গাছ শান্ত ছায়া দিচ্ছে। পুকুরটির চারদিক দেয়াল দিয়ে ঘেরা। এ ছাড়া ব্লকসহ নানা রকম স্থাপত্য সৌন্দর্যে সাজানো হয়েছে পুকুরটি। সম্প্রতি পুকুরটির সৌন্দর্য বর্ধন করা হয়েছে। রাতে ফোয়ারাটি সচল হয়ে উঠলে পাবলিক লাইব্রেরি ও জেলা পরিষদ আঙিনায় মনোমুগ্ধকর এক পরিবেশ তৈরি হয়।

মৌলভীবাজার জেলা পরিষদ সূত্রে জানা গেছে, কয়েক বছর ধরে পুকুরটি ঘিরে সৌন্দর্যবর্ধনের কাজ চলছে। এর মধ্যে পুকুরপাড়ের পুরোনো দেয়াল ভেঙে নতুন দেয়াল নির্মাণ করা হয়েছে। গাইড ওয়ালসহ সৌন্দর্যবর্ধনের জন্য ব্লক স্থাপন ও পাকা ঘাট নির্মাণ করা হয়েছে। পুকুরের মাঝখানে তৈরি করা হয়েছে ফোয়ারা। এতে এ পর্যন্ত প্রায় ৩০ লাখ টাকা খরচ হয়েছে।

জেলা পরিষদ কার্যালয়সংলগ্ন এলাকায় বাস করেন শোভাময় রায়। তিনি শুধু এই এলাকার বাসিন্দা বলেই গোল পুকুরের প্রতিবেশী নন, ১৯৮১ সাল থেকে পাবলিক লাইব্রেরির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছেন। অনেক বছর ধরে গ্রন্থাগারিকের দায়িত্বে আছেন শোভাময় রায়।

গ্রন্থাগারিক শোভাময় প্রথম আলোকে বলেন, ‘এই পুকুরপাড়েই আমার জন্ম। ছোটবেলা থেকে এই পুকুর দেখে বড় হয়েছি। দূরদূরান্ত থেকে মানুষ এই পুকুর দেখতে আসতেন। পুকুরটির বয়স নির্দিষ্ট করে বলা কঠিন। কিন্তু শত বছরের কাছাকাছি হবে। শুনেছি, পাবলিক লাইব্রেরিসহ অন্য সব ভবনের ভিটা তৈরি করতে এই পুকুর খনন করা হয়েছিল। এই পুকুরে নওশের আলী নামের এক ডুবুরি তিনবার তাঁর ক্রীড়াশৈলী প্রদর্শন করেছেন। পুকুরঘাটে পয়লা বৈশাখসহ বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়েছে।’

সাহিত্যের ছোটকাগজ কোরাসের সম্পাদক ও কবি মুজাহিদ আহমদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘এই পুকুরের কাছে গেলে মন ভালো হয়ে যায়। ঐতিহ্যবাহী গোল পুকুরটিকে নাগরিক হৃদয় বলা চলে। সম্প্রতি শোভাবর্ধনের কাজ হয়েছে। এতে ভীষণ ভালো লাগছে। সুযোগ পেলেই এই পুকুরঘাটে গিয়ে বসি। পুকুরের পশ্চিমপাড়ে মৌলভীবাজার পাবলিক লাইব্রেরি। ওখানে বই আর পুকুরের সৌন্দর্যে একসঙ্গে ডুব দেওয়া যায়।’

মৌলভীবাজার জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মিছবাহুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘গোল পুকুরটি ঘিরে বেশ কিছু সৌন্দর্যবর্ধনের কাজ করা হয়েছে। কিন্তু যা–ই করেছি, পুকুরটির আদল ঠিক রেখে করা হয়েছে। পুকুরটি যেভাবে ছিল, সেভাবেই আছে। ফোয়ারা চালু হলে রাতে অসম্ভব সুন্দর লাগে। একসঙ্গে সব কাজ করার আর্থিক সংগতি নেই। যে কারণে আস্তে আস্তে পুকুরসহ কার্যালয় এলাকাকে নান্দনিক করার পরিকল্পনা আছে।’