বরাদ্দ কম, কাটছে না দুর্দশা

মাছ ধরার ওপর নিষেধাজ্ঞা চলাকালে জেলেদের নির্দিষ্ট পরিমাণের চাল দেওয়া হয়। কিন্তু ওই চাল দিয়ে তাঁদের সংসার চলে না। উপরন্তু অনেকে চালও পান না।

সূত্র: বরিশাল বিভাগীয় মৎস্য অধিদপ্তর

‘নদী ও সাগরে নিষেধাজ্ঞার চাপে মোগো জীবনডা চ্যাপটা অইয়্যা গ্যাছে। কষ্টের কথা কইতেও পারি না আর সইতেও পারি না। ঘরে পাঁচজন খাওনদার। সরকার যে চাউল দেয়, হ্যাতে দুই মাসের খোরাকিও (খাবার সংস্থান) অয় না। হ্যারপর বাজার-সওদা, পরিবারের খরচ তো আছেই। নিষেধাজ্ঞা পড়লে পোলাপানের মোহের দিক চাইতে পারি না। ভাত আর আলুসেদ্ধ এই অইলো মোগো খাওন। তা–ও প্যাট ভইর‌্যা খাইতে দেতে পারি না।’

এ কথাগুলো বরগুনা সদরের মাছখালী গ্রামের জেলে মো. ছগির হোসেনের (৫০)। বিষখালী নদীর পারে ছাপড়া তুলে বসবাস করেন। নিজের ছোট নৌকা নিয়ে বিষখালী ও সাগর মোহনায় ইলিশ মাছ ধরেন। কোনো দিন মাছ পান, কোনো দিন খালি হাতে ফেরেন। যখন মাছ ধরার ওপর নিষেধাজ্ঞা থাকে না, তখন দিনগুলো কোনোমতে কেটে যায়। কিন্তু নিষেধাজ্ঞার সময় তাঁর পরিবারে নেমে আসে দুর্দিন।

সব জেলেকে হয়তো এ সুবিধার আওতায় আনা যাবে না। তবে সামর্থ্যের দিক বিবেচনা করে প্রতিবছরই এ সুবিধাভোগীর সংখ্যা বাড়ানো হচ্ছে, ভবিষ্যতে আরও বাড়বে।
আনিসুর রহমান তালুকদার, উপপরিচালক, বরিশাল বিভাগীয় মৎস্য অধিদপ্তর

বিভাগীয় মৎস্য অধিদপ্তর সূত্র জানায়, দেশের নদ-নদী ও বঙ্গোপসাগরে ইলিশসহ অন্যান্য মাছের প্রজনন নির্বিঘ্ন করতে বছরের ৩৬৫ দিনের মধ্যে ১৪৮ দিনই মাছ ধরার ওপর নিষেধাজ্ঞা থাকে। অক্টোবরে মা ইলিশ সংরক্ষণে ২২ দিনের নিষেধাজ্ঞা, মার্চ-এপ্রিল মাসে ইলিশের ছয় অভয়াশ্রমে ৬০ দিনের নিষেধাজ্ঞা এবং এরপর ২০ মে থেকে ২৩ জুলাই পর্যন্ত সাগরে ৬৫ দিনের নিষেধাজ্ঞা থাকে। এর বাইরে জাটকা রক্ষায় ১ নভেম্বর থেকে ৩০ জুন পর্যন্ত ৮ মাসের নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। এ নিষেধাজ্ঞার সময় সরকার যে খাদ্যসহায়তা দেয়, তা সব জেলে পান না। আবার চাহিদার তুলনায় খুব চাল দেওয়া হয়। এ সহায়তা বিতরণেও রয়েছে নানামুখী অনিয়ম। তাই এ সময় বিকল্প কোনো কর্মসংস্থান না থাকায় বরগুনার ছগির হোসেনের মতো সাড়ে তিন লাখ জেলে পরিবার নিয়ে ভীষণ কষ্টে দিন কাটান।

বরিশাল মৎস্য অধিদপ্তর জানায়, বরিশাল বিভাগে নিবন্ধিত জেলের সংখ্যা ৩ লাখ ৪৩ হাজার ১১৯ জন। এর মধ্যে ১ লাখ ৪৭ হা্জার ৮৩ জন জেলে সাগরে গিয়ে মাছ ধরেন। ১ লাখ ৯৬ হাজার ৩৬ জন সাগর মোহনায় ও নদ-নদীতে মাছ শিকার করেন। সর্বশেষ ২০১৭ সালে জেলে নিবন্ধন তালিকা হালনাগাদ হয়েছে। এরপর আর হালনাগাদ করা হয়নি এ তালিকা। ফলে অনেক নতুন জেলে সুবিধাবঞ্চিত হচ্ছেন।

মৎস্য অধিদপ্তরের হিসাব বলছে, জাটকা ধরায় আট মাসের নিষেধাজ্ঞার সময় ৪০ কেজি করে চারবারে ১৬০ কেজি চাল সহায়তা পেয়েছেন বিভাগে ২ লাখ ৬১ হাজার ১৮৯ জেলে। আবার ২২ দিনের নিষেধাজ্ঞা চলাকালে ২০ কেজি করে চালসহায়তা পেয়েছিলেন ৩ লাখ ৭ হাজার ১২৪ জেলে। আবার ৬৫ দিনের সামুদ্রিক মাছ ধরায় নিষেধাজ্ঞার সময় ৮৬ কেজি করে সহায়তা পান ১ লাখ ৪৭ হাজার ৮৩ জন জেলে। তিন দফায় এ সহায়তার বিষয়টি পর্যালোচনা করে দেখা যায়, অন্তত এক লাখ জেলে প্রতিবছরই নিষেধাজ্ঞার সময় কোনো ধরনের সহায়তার বাইরে থাকছেন। আবার সহায়তা বিতরণেও দুর্নীতি ও অনিয়মের কারণে সহায়তার পুরোপুরি পাচ্ছেন না অনেক জেলে।

নিবন্ধিত জেলেরাও যে সরকারি সহায়তা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন, তার প্রমাণ পাওয়া যায় বরগুনা জেলায় সরকারি সহায়তা পাওয়া জেলেদের হিসাব থেকে। এ জেলায় নিবন্ধিত জেলে ৩৭ হাজার ৩০৯ জন। এর মধ্যে ৮৬ দিনের নিষেধাজ্ঞা চলাকালে জেলার ২৭ হাজার ২৭৭ জন এবং জাটকা ধরায় ৮ মাসের নিষেধাজ্ঞা চলাকালে ২৮ হাজার জেলে সহায়তা পান।

সম্প্রতি বরগুনার সদরের ঢলুয়া ইউনিয়নের জেলেদের ৪০ কেজি করে চাল দেওয়া হলেও পরিবহন খরচ বলে প্রত্যেকের কাছ থেকে এক হাজার টাকা থেকে ১ হাজার ৫০০ টাকা করে নেওয়া হয়।

ডালভাঙ্গা এলাকার মো. মনির বলেন, সহায়তার চাল নিতে হলে টাকা দিতে হয়। ইউনিয়ন পরিষদের চৌকিদার চেয়ারম্যানের কথা বলে এসব টাকা নেন। দক্ষিণ ডালভাঙ্গা গ্রামের জেলে আবদুল হক বলেন, ‘জাটকার নিষেধাজ্ঞা চলাকালে ৮০ কেজি চাল পেয়েছি। সে জন্য আমাকে ইউপির চৌকিদারকে ৫০০ টাকা দিতে হয়েছে। টাকা না দিলে নাম থাকবে না, এমন হুঁশিয়ারির পর টাকা দিয়েছি।’

অবশ্য জেলেদের ওজনে চাল কম দেওয়া এবং চাল পরিবহনের নামে টাকা আদায় করার অভিযোগের বিষয়ে ঢলুয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আজিজুল হক বলেন, ‘এসব অভিযোগের বিষয়ে আমি কিছুই জানি না। জেলেরা যদি কারও কাছে টাকা দিয়ে থাকে, সেটা তাদের ব্যাপার। এতে আমার কোনো সম্পৃক্ততা নেই।’

সরকারি বাজেট বরাদ্দের ব্যবহার নিয়ে কাজ করা বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ডেমোক্রেটিক বাজেট আন্দোলনের ‘পিচ্ছিল পথে অর্থনীতি, জীবন-জীবিকা রক্ষায় জন-প্রত্যাশা’ শীর্ষক এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত কয়েক দশকে সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচিতে সুবিধাভোগীর সংখ্যা কাগজে-কলমে বাড়লেও সুবিধাভোগী নির্বাচনে দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতির কারণে প্রকৃত জনগোষ্ঠীর বড় একটি অংশ বঞ্চিত হচ্ছে।

দেশে মৎস্যসম্পদ ও জেলেদের জীবনমানের উন্নয়নে কাজ করছে আন্তর্জাতিক মৎস্য গবেষণা প্রতিষ্ঠান ওয়ার্ল্ডফিশের ইকোফিশ প্রকল্প-২। এ প্রকল্পের দলনেতা মৎস্যবিজ্ঞানী অধ্যাপক আবদুল ওহাব বলেন, জেলে সম্প্রদায়ের এক-তৃতীয়াংশ শুধু সাগরে এবং এক-তৃতীয়াংশ শুধু নদীতে মাছ ধরেন। এক-তৃতীয়াংশ সাগর ও নদী উভয় জায়গায় মাছ ধরেন। তাই যেখানেই নিষেধাজ্ঞা হোক না কেন, এক-তৃতীয়াংশ জেলে চরম ক্ষতিগ্রস্ত হন।

মাছ ধরায় নিষেধাজ্ঞা চলাকালে জেলেদের সমস্যা সমাধানের বিষয়ে তিনি বলেন, জেলেদের দুর্দশা লাঘবে নিষেধাজ্ঞা চলাকালে চালের পাশাপাশি প্রত্যেক জেলেকে অন্তত নগদ দুই হাজার করে টাকা দেওয়া যেতে পারে। নিষেধাজ্ঞা চলাকালে ক্ষতিগ্রস্ত সব জেলে যাতে সহায়তা পান, সে জন্য তালিকা প্রণয়নে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে। এ ছাড়া নিবন্ধিত সব জেলের সহায়তা পাওয়ার ব্যাপারে যথাযথ উদ্যোগ নিতে হবে।

এ বিষয়ে মৎস্য অধিদপ্তরের বরিশাল বিভাগীয় উপপরিচালক মো. আনিসুর রহমান তালুকদার বলেন, ‘নিষেধাজ্ঞাকালীন জেলেদের যাতে দুর্দশায় পড়তে না হয়, সে জন্য সরকার সহায়তা দিচ্ছে।’