রাঙামাটিতে হাজার কোটি টাকার কলার বাজার
রাঙামাটি জেলার অন্তত এক হাজার কৃষক যুক্ত হয়েছেন কলা চাষে। কেউ একক বাগান করছেন, আবার কেউ অন্যান্য ফসলের সঙ্গে কলার চাষ করছেন। চাষিরা জানান, রাঙামাটির মাটি ও আবহাওয়া কলা চাষের জন্য খুবই উপযোগী। আবার এটি চাষ করতে বেশি পরিচর্যার দরকার হয় না।
পাহাড়ের ঢালে সারি সারি কলাগাছ। সকালে রোদ ছড়াতেই সেখানে হাজির বাজেক্কে চাকমা। কয়েক শ গাছের নিচে ঝুলে থাকা কলার ছড়ি একে একে কেটে এক পাশে স্তূপ করলেন তিনি। গাছে থাকা অবস্থাতেই এগুলো বিক্রি করেছেন বাজেক্কে। প্রতি ছড়িতে দাম পেয়েছেন ২০০ থেকে ৩০০ টাকা।
বাজেক্কে চাকমার বাড়ি রাঙামাটির সাজেক ইউনিয়নে বাঘাইহাট-সাজেক সড়কের নন্দারাম এলাকায়। লাভজনক হওয়ায় নিজ উদ্যোগেই এলাকায় এ কলাবাগান করেছেন তিনি। বর্তমানে তাঁর বাগানে গাছ রয়েছে এক হাজারের বেশি। প্রতি সপ্তাহে অন্তত ২০০ কলার ছড়ি বিক্রি করেন তিনি। এ আয় দিয়েই সংসার চলে তাঁর।
অবশ্য শুধু বাজেক্কে চাকমা নয়, রাঙামাটি জেলার অন্তত এক হাজার কৃষক যুক্ত হয়েছেন কলা চাষে। কেউ একক বাগান করছেন, আবার কেউ অন্যান্য ফসলের সঙ্গে কলার চাষ করছেন। চাষিরা জানান, রাঙামাটির মাটি ও আবহাওয়া কলা চাষের জন্য খুবই উপযোগী। আবার এটি চাষ করতে বেশি পরিচর্যার দরকার হয় না। কীটনাশক ব্যবহারেরও তেমন প্রয়োজন হয় না। তাই কৃষকেরা কলা চাষে ঝুঁকছেন।
বাঘাইছড়ির নবছড়া গ্রামের কলাচাষি সমীরণ চাকমা প্রথম আলোকে বলেন, তিনি দুই বছর আগে আট একর জমিতে সাড়ে চার হাজার কলাগাছ লাগিয়েছেন। ছয় মাস ধরে কলা বিক্রি করছেন। এখন পর্যন্ত প্রায় এক লাখ টাকার কলা বিক্রি করেছেন। আগামী কয়েক মাসে আরও দু–তিন লাখ টাকার কলা বিক্রি করতে পারবেন বলে তাঁর আশা।
রাঙামাটি কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, জেলায় বর্তমানে ১১ হাজার ৯০০ হেক্টর জমিতে কলা চাষ হচ্ছে। প্রতি হেক্টর জমিতে বছরে প্রায় ৩০ মেট্রিক টন কলা উৎপাদিত হয়। সেই হিসাবে পুরো জেলায় প্রতিবছর ৩ লাখ ৫৭ হাজার মেট্রিক টন কলা উৎপাদিত হয়। এসব কলার বাজারমূল্য ২ হাজার ৮৫৬ কোটি টাকা। বাংলা কলা, চাঁপা কলা, সাগর কলা, সূর্যমুখী, আনাজি জাতের কলাগুলোই এখানে বেশি চাষ হচ্ছে। তবে এ জেলায় ‘বাংলা কলার’ কদরই বেশি। উপজেলার হিসাবে সবচেয়ে বেশি কলা চাষ হচ্ছে নানিয়ারচরে।
কলা কৃষিপণ্য হলেও এটি চাষে কৃষি বিভাগের কোনো ভূমিকা নেই। কলাচাষিদের কোনো সহায়তা কিংবা প্রণোদনা আমরা দিই না। সরকারিভাবে এর কোনো নির্দেশনাও নেই। তবে নিজ উদ্যোগে কর্মকর্তারা কৃষকদের নানা পরামর্শ দিচ্ছেন।দেবাশীষ দেওয়ান, উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা, রাঙামাটি সদর উপজেলা
কলা চাষকে ঘিরে সুদিন ফিরেছে ব্যবসায়ীদেরও। চাষিদের কাছ থেকে কম দামে কিনে ঢাকা, চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় সরবরাহ করছেন তাঁরা। স্থানীয় ব্যবসায়ীরা জানান, কৃষকের কাছ থেকে এক থেকে চার টাকা দরে তাঁরা কলা কেনেন। সেই কলা স্থানীয় বাজার কিংবা দেশের বিভিন্ন জায়গা বিক্রি করেন। প্রতি কলায় দুই থেকে চার টাকা পর্যন্ত লাভ হয় তাঁদের।
বাঘাইছড়ি সাজেকের কলা ব্যবসায়ী সবিনয় চাকমা ও নানিয়ারচরে অন্তর চাকমা প্রথম আলোকে বলেন, বাগান ঘুরে তাঁরা চাষিদের কাছ থেকে কলা সংগ্রহ করেন। অনেক সময় চাষিরাও বাজারে নিয়ে আসেন। তাঁরা এসব কলা সংগ্রহ করে ঢাকা, চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তের ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করেন। পুরো জেলায় তাঁদের মতো অন্তত তিন হাজার ব্যবসায়ী রয়েছেন। রাঙামাটি এ কলা চাষ পুরোপুরি নিজ উদ্যোগে করছেন বলে জানিয়েছেন চাষিরা। মূলত প্রাকৃতিকভাবে উপযোগী জমি, সহজ পরিচর্যা আর কম খরচ—এই তিনে ভর করে কলা চাষের বিশাল অর্থনীতি গড়ে তুলেছেন তাঁরা।
রাঙামাটি কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, জেলায় বর্তমানে ১১ হাজার ৯০০ হেক্টর জমিতে কলা চাষ হচ্ছে। প্রতি হেক্টর জমিতে বছরে প্রায় ৩০ মেট্রিক টন কলা উৎপাদিত হয়। সেই হিসাবে পুরো জেলায় প্রতিবছর ৩ লাখ ৫৭ হাজার মেট্রিক টন কলা উৎপাদিত হয়। এসব কলার বাজারমূল্য ২ হাজার ৮৫৬ কোটি টাকা।
জানতে চাইলে সদর উপজেলা উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা দেবাশীষ দেওয়ান প্রথম আলোকে বলেন, ‘কলা কৃষিপণ্য হলেও এটি চাষে কৃষি বিভাগের কোনো ভূমিকা নেই। কলাচাষিদের কোনো সহায়তা কিংবা প্রণোদনা আমরা দিই না। সরকারিভাবে এর কোনো নির্দেশনাও নেই। তবে নিজ উদ্যোগে কর্মকর্তারা কৃষকদের নানা পরামর্শ দিচ্ছেন।’
রাঙামাটি কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মোহাম্মদ মুনিরুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে কলা চাষের বিশাল সম্ভাবনা আছে। পরিকল্পিতভাবে বাণিজ্যিক চাষ হলে এবং সরকারি সহযোগিতা মিললে উৎপাদন কয়েক গুণ বাড়ানো সম্ভব। শুধু দেশের চাহিদা নয়, রপ্তানিও করা যাবে।