হুছনেয়ারার সংসারে এসেছে স্বাচ্ছন্দ্য, স্বস্তি নারীদের 

বাড়িতেই পণ্য রাখেন হুছনেয়ারা। সিলেটের উত্তর বালুচর জোনাকি এলাকায়
ছবি: প্রথম আলো

যোগাযোগবিড়ম্বিত এলাকা হওয়ায় আশপাশের বাজারের ফার্মেসি কিংবা স্টেশনারি দোকানে যেতে বেশির ভাগ নারীই অনাগ্রহী ছিলেন। ফলে প্যাড কিনতে না পেরে পুরোনো কাপড়ই পিরিয়ড বা ঋতুস্রাবের সময় তাঁরা ব্যবহার করতেন। অনেকে জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি গ্রহণ করতে পারতেন না। দীর্ঘদিনের এ সমস্যা দুই বছরে ঘুচিয়ে দিয়েছেন হুছনেয়ারা বেগম (৪২)।

হুছনেয়ারা বাড়ি বাড়ি গিয়ে প্যাড, কনডম আর জন্মনিয়ন্ত্রণ বড়ি বিক্রি করেন। একই সঙ্গে নারীদের নানা ধরনের প্রসাধনী, নারকেল তেল, সাবান, টুথপেস্ট, ক্রিম, শ্যাম্পু, ডিটারজেন্ট, গুঁড়া দুধ, খাওয়ার স্যালাইন, নিত্যপ্রয়োজনীয় ওষুধপথ্যসহ অন্তত ৫০ ধরনের পণ্য বিক্রি করেন। এতে একদিকে যেমন হুছনেয়ারার সংসারে স্বাচ্ছন্দ্য এসেছে, আর উপকারভোগী নারীরা পেয়েছেন স্বস্তি।

হুছনেয়ারার মনে এমন ব্যবসার চিন্তা ঢোকে ২০২১ সালে উদ্যোক্তা প্রকল্পে অন্তর্ভুক্ত হয়ে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে। বহুজাতিক তেল ও গ্যাস কোম্পানি শেভরনের পৃষ্ঠপোষকতায় উদ্যোক্তা প্রকল্পের অধীন ব্যবসায় ব্যবস্থাপনা প্রশিক্ষণ ও বিভিন্ন কোম্পানির সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দেওয়ার যাবতীয় কাজ করছে ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট এন্টারপ্রাইজ (আইডিই) নামের একটি বেসরকারি সংস্থা।

হুছনেয়ারা জানান, তিনি একজন স্বাস্থ্যকর্মী হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেছিলেন। নারী, শিশুর সেবা করে কিছু ভাতা পেতেন। তবে এ আয়ে সংসারের চাহিদা মিটত না। এ জন্য বিকল্প কাজের সন্ধান করেছিলেন। তখনই উদ্যোক্তা প্রকল্পে প্রশিক্ষণ নেন। ব্যবসা পরিচালনার কৌশল ভালোভাবে রপ্ত করেন। এখন সিলেট নগরের বন্দরবাজার, কালীঘাট ও মীরাপাড়া এলাকার বিভিন্ন কোম্পানি থেকে পাইকারি দরে নারী ও শিশুদের পণ্য কিনে গ্রামের নারীদের কাছে বিক্রি করছেন। 

হুছনেয়ারা চারজন নারী বিক্রয় প্রতিনিধির সমন্বয়ে একটা ‘হাব’ তৈরি করেছেন। ওই চার নারী বিক্রয় প্রতিনিধি তাঁর কাছ থেকে বাজারদরের চেয়ে কিছু কম দামে পণ্য কিনে পৃথক ব্যবসা পরিচালনা করছেন। হুছনেয়ারা জানান, যোগাযোগবিড়ম্বিত এলাকা হওয়ায় কিছু পণ্য স্থানীয় দোকানে পাওয়া গেলেও তা গ্রাহকদের বেশি দামে কিনতে হয়। এ অবস্থায় তাঁদের কাছ থেকে বাজারমূল্যের চেয়ে তুলনামূলকভাবে কম দামে গ্রাহকেরা পণ্য কেনার সুবিধা পান। এতে তাঁদের বেচাকেনাও ভালো হয়। 

হুছনেয়ারার বাড়ি সিলেট সদর উপজেলার টুলটিকর ইউনিয়নের উত্তর বালুচর জোনাকি গ্রামে। গ্রামটি সম্প্রতি সিলেট সিটি করপোরেশন ৩৬ নম্বর ওয়ার্ডে যুক্ত হয়েছে। উত্তর বালুচর জোনাকির আশপাশের এলাকা দলদলি চা-বাগান, সবজি বাড়ি, কাঁঠালবাগানসহ বিভিন্ন স্থানে হুছনেয়ারা পণ্য বিক্রি করেন। এ ছাড়া তাঁর কাছ থেকে পণ্য কিনে অন্য নারী বিক্রয় প্রতিনিধিরা খারাদিপাড়া, খাদিমপাড়া, উত্তর বালুচরসহ বিভিন্ন এলাকায় ফেরি করে বিক্রি করেন।

হুছনেয়ারা বেগম জানান, বাসায় একটি শোকেসে পণ্য সাজিয়ে রেখেছেন। আশপাশের বাজার এবং দোকানে নারী ও শিশুদের প্রয়োজনীয় পণ্য মেলে না। তাই বাসাতেই এখন নারীরা এসব পণ্য কিনতে ভিড় জমান। এ ছাড়া তিনি প্রতি শুক্রবার পাশের দলদলি চা-বাগানসহ বিভিন্ন স্থানে গিয়ে নারীদের নিয়ে উঠান বৈঠক করে এসব সামগ্রী বিক্রি করেন। সব মিলিয়ে প্রতি মাসে তাঁর ১২ থেকে ১৪ হাজার টাকা আয় হয়। 

হুছনেয়ারার স্বামী মো. আবদুল কাদের একটি ইলেকট্রনিকসের দোকানের ব্যবস্থাপক। তাঁদের দুই ছেলেসহ পরিবারের সদস্যসংখ্যা সাতজন। একটা সময় অভাব থাকলেও তা এখন দূর হয়েছে। স্বামী ও তাঁর আয়ে সংসার ভালোভাবেই চলছে। ভবিষ্যতে তিনি ব্যবসার পরিসর আরও বাড়াতে চান জানিয়ে বলেন, ‘আমি ব্যবসায়িক সাফল্যের রোল মডেল হতে চাই। আমাকে দেখে আরও নারী এ ব্যবসায় আসুক, এটাই চাই।’