নির্বাচনমুখী আওয়ামী লীগ, ফখরুলকে ঘিরে চলছে বিএনপি

সম্ভাব্য প্রার্থীদের তৎপরতায় বিভক্ত তৃণমূল আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা। দাবি আদায় হলে নির্বাচনে যাওয়ার প্রস্তুতি বিএনপিতে।

সংগঠন গোছানোর চেয়ে জাতীয় নির্বাচনকেই এখন বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে ঠাকুরগাঁও জেলা আওয়ামী লীগ। আর বিএনপির সব মনোযোগ ‘সরকার পতনের’ আন্দোলনে। দাবি আদায় হলে নির্বাচনে যাওয়ার বিষয়ে ভাবতে চান বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের জেলার নেতারা।

সংসদ নির্বাচনের সময় যত ঘনিয়ে আসছে, ঠাকুরগাঁওয়ে আওয়ামী লীগের মনোনয়নপ্রত্যাশীদের তৎপরতা ততই বাড়ছে। এলাকায় ব্যানার-ফেস্টুন টানানোর পাশাপাশি তাঁরা গণসংযোগ চালাচ্ছেন। এমন অবস্থায় তৃণমূল নেতা-কর্মীদের কাছে ছুটছেন বর্তমান সংসদ সদস্যরাও। আওয়ামী লীগের বেশির ভাগ সহযোগী ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনের হালনাগাদ কমিটি না থাকায় হতাশা রয়েছে নেতা-কর্মীদের মধ্যে।

ঠাকুরগাঁও জেলায় বিএনপির কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয় মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের নির্দেশনাতেই। তাঁকে ঘিরেই ঐক্যবদ্ধ বিএনপি এখন এক দফার আন্দোলনের মাঠে রয়েছে। দলের সহযোগী সংগঠনগুলোরও হালনাগাদ কমিটি না থাকলেও আন্দোলনের কর্মসূচি ঘিরে চাঙা হয়ে উঠেছেন নেতা-কর্মীরা।

সহযোগী সংগঠনগুলো অগোছালো

ঠাকুরগাঁও জেলা আওয়ামী লীগের সর্বশেষ কমিটি হয়েছিল ২০১৯ সালের ৬ ডিসেম্বর। এতে মু. সাদেক কুরাইশী সভাপতি ও দীপক কুমার রায় সাধারণ সম্পাদক হন। আট সহযোগী সংগঠনের মধ্যে কেবল কৃষক লীগ, যুব মহিলা লীগ ও মৎস্যজীবী লীগের কমিটি হালনাগাদ রয়েছে। তিন বছর পরপর নতুন কমিটি হওয়ার কথা থাকলেও ছয় বছরের কমিটিতে চলছে যুবলীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগ। পাঁচ বছরের কমিটিতে চলছে মহিলা আওয়ামী লীগ। তাঁতী লীগের কমিটিও তিন বছরের পুরোনো। কমিটি ছাড়াই চলছে বঙ্গবন্ধু আওয়ামী আইনজীবী পরিষদ। ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন ছাত্রলীগের কমিটি গত ৯ জুলাই থেকে বিলুপ্ত।

জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক দীপক কুমার রায় বলেন, ‘এখন নির্বাচনের সময়। আমরাও নির্বাচনমুখী। এ সময় দলের সহযোগী এবং ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনগুলোর নতুন কমিটি গঠনের কথা ভাবছি না। নির্বাচনে জয়ী হয়েই নতুন করে দল গোছানো হবে।’

জেলা বিএনপির সর্বশেষ সম্মেলন হয়েছিল ২০১৭ সালের ৩১ ডিসেম্বর। এতে তৈমুর রহমান সভাপতি ও মির্জা ফয়সল আমীন সাধারণ সম্পাদক হন। এরপর তারিখ ঘোষণা করেও সম্মেলন করতে পারেনি দলটি। সহযোগী সংগঠনের মধ্যে কেবল মহিলা দল ও তাঁতী দলের কমিটির মেয়াদ রয়েছে। জেলা যুবদলের সর্বশেষ সম্মেলন হয়েছিল ২০১৬ সালের ১৬ নভেম্বর।

সেই কমিটির সভাপতি চৌধুরী মাহেবুল্লাহ আবুনুর কেন্দ্রীয় সহসভাপতি হয়েছেন আর সাধারণ সম্পাদক মাহবুব হোসেন পেয়েছেন সদর উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদকের পদ। স্বেচ্ছাসেবক দলের কমিটি পাঁচ বছরের পুরোনো। চার বছরের পুরোনো কমিটিতে চলছে কৃষক দল ও মৎস্যজীবী দল। জাসাসের ১০ বছর আগে গঠিত আহ্বায়ক কমিটি সম্প্রতি ভেঙে দেওয়া হয়েছে। ৯ বছর ও ৭ বছরের পুরোনো কমিটিতে চলছে শ্রমিক দল ও ছাত্রদল।

জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক মির্জা ফয়সল আমীন বলেন, ‘আমরা এক দফার আন্দোলনে থাকলেও দল পুনর্গঠনের কাজটিও করে যাচ্ছি। জেলার পাঁচটি উপজেলার সব কটিতেই বিএনপির হালনাগাদ কমিটি রয়েছে।’

সংসদ সদস্যরা চাপে

ঠাকুরগাঁওয়ের তিনটি সংসদীয় আসনের দুটিতে আওয়ামী লীগ ও অন্যটিতে জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য রয়েছেন। আগামী নির্বাচনে এই তিন আসনে বর্তমান সংসদ সদস্যসহ আওয়ামী লীগের অন্তত ২৪ জন দলীয় মনোনয়ন প্রত্যাশা করছেন।

২০১৮ সালের ঠাকুরগাঁও-১ (সদর) আসনে মির্জা ফখরুল ইসলামকে হারিয়ে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন রমেশ চন্দ্র সেন। নেতা-কর্মীদের অভিযোগ, কোনো প্রয়োজনে রমেশের কাছে গেলে তিনি গুরুত্ব দেন না। তবে গত দুই মাসে নির্বাচনী এলাকায় ৩৯টি স্থানে সভা করে জনগণের বেশ সাড়া পেয়েছেন বলে দাবি করেছেন রমেশ চন্দ্র সেন।

রমেশ চন্দ্রের বিরুদ্ধে অসন্তোষের সুযোগে নৌকার মাঝি হতে অন্তত নয়জন তৎপরতা শুরু করেছেন। তাঁদের মধ্যে আছেন সদর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি অরুণাংশু দত্ত, সাবেক সংসদ সদস্য খাদেমুল ইসলামের ছেলে সাহেদুল ইসলাম, জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক দীপক কুমার রায়, জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মু. সাদেক কুরাইশী, আইনবিষয়ক সম্পাদক ইন্দ্রনাথ রায়, ঠাকুরগাঁও পৌরসভার মেয়র অাঞ্জুমান আরা বেগম প্রমুখ।

সাহেদুল ইসলাম বলেন, ‘জননেত্রী শেখ হাসিনা এখন স্মার্ট বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখাচ্ছেন। এবারের নির্বাচনেও তরুণেরাই অগ্রাধিকার পাবেন। আমি তাঁর নির্দেশেই এলাকায় কাজ করে যাচ্ছি। এলাকার মানুষও আমার সঙ্গে আছেন।’

অরুণাংশু দত্ত বলেন, বর্তমান সংসদ সদস্যের অনেক বয়স হয়েছে। তৃণমূল কর্মিসভায় তিনি কর্মীদের ক্ষোভের মুখে পড়ছেন।

গত সাতটি নির্বাচনে ঠাকুরগাঁও-২ (বালিয়াডাঙ্গী-হরিপুর) আসনের সংসদ সদস্য হন আওয়ামী লীগের দবিরুল ইসলাম। তাঁর পাশাপাশি তাঁর বড় ছেলে জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মাজহারুল ইসলাম, বালিয়াডাঙ্গী উপজেলা যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক ও উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আলী আসলাম, জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মোস্তাক আলম, জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি প্রবীর কুমার রায়, বালিয়াডাঙ্গী আওয়ামী লীগের সভাপতি মোহাম্মদ আলী, ছাত্রলীগের প্রথম সভাপতি দবিরুল ইসলামের ছেলে আহসান উল্লাহ, হরিপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি এ কে এম শামীম ফেরদৌস মনোনয়ন পেতে তৎপর আছেন।

দবিরুল ইসলাম বলেন, তৃণমূলের নেতা-কর্মীরা তাঁর সঙ্গেই আছেন। তবে ষড়যন্ত্র চলছে। সেই ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করে এবারও মনোনয়ন পাবেন বলে তিনি আশাবাদী।

মোস্তাক আলম বলেন, বর্তমান সংসদ সদস্য অসুস্থ। তিনি সেভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারছেন না।এ অবস্থায় শুধু জনগণ নয়, দলের নেতা-কর্মীরাও তাঁর বিকল্প খুঁজছেন। আহসান উল্লাহ বলেন, ‘রাজনীতি এখন কিছু মানুষের কাছে জিম্মি হয়ে গেছে। এখন সেই জমিদারও নেই, জমিদারিও নেই। এই আসনেও পরিবর্তন আসবেই। আমার মনোনয়ন দিয়েই সেই পরিবর্তনের সূচনা হবে।’

জোটের রাজনীতির কারণে ঠাকুরগাঁও-৩ (রানীশংকৈল ও পীরগঞ্জ) আসনটি কখনো জাতীয় পার্টি, আবার কখনো ওয়ার্কার্স পার্টিকে ছেড়ে দেয় আওয়ামী লীগ। এবার ছাড় দিতে নারাজ নেতারা। এখানে তৎপর রয়েছেন অন্তত সাতজন। এ আসনের বর্তমান সংসদ সদস্য জাতীয় পার্টির হাফিজ উদ্দিন আহম্মেদ।

জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মু. সাদেক কুরাইশী বলেন, মনোনয়ন নিয়ে প্রতিযোগিতা রয়েছে, তবে কোনো বিভেদ নেই। জেলায় দল যেকোনো সময়ের চেয়ে শক্তিশালী।

আন্দোলনের পর নির্বাচনের ভাবনা বিএনপির

বিএনপির নেতা-কর্মীরা বলছেন, নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি আদায়ই এখন তাঁদের মূল লক্ষ্য। জেলা বিএনপির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক পয়গাম আলী বলেন, ‘এক দফার দাবি সফল করেই আমরা নির্বাচনে যাব। আর নির্বাচনে গেলে ঠাকুরগাঁও–১ আসনে বিএনপির প্রার্থী হবেন মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।’

২০০১, ২০০৮ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনে ঠাকুরগাঁও-২ আসনটি জামায়াতকে ছেড়ে দেয় বিএনপি। প্রতিবারই জামায়াতের প্রার্থী পরাজিত হন। বিএনপির স্থানীয় নেতা-কর্মীরা এবার আসনটি চান। সে ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় অন্তত চারজন নেতা মনোনয়ন চাইতে পারেন বলে জানিয়েছেন একাধিক নেতা-কর্মী।

ঠাকুরগাঁও-৩ আসনে ২০১৮ সালের নির্বাচনে জয়ী হয়েছিলেন পীরগঞ্জ উপজেলা বিএনপির সভাপতি জাহিদুর রহমান। দলের সিদ্ধান্তে তিনি গত বছরের ডিসেম্বরে পদত্যাগ করেন। নির্বাচন নিয়ে তিনি বলেন, জনগণ বিএনপিকে ভোট দেওয়ার জন্য অপেক্ষায় আছে। কিন্তু দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হলে তাদের ইচ্ছার প্রতিফলন হবে না। তাই এখন এক দফার আন্দোলন ছাড়া অন্য কোনো কিছু ভাবার সুযোগ নেই।

জেলা বিএনপির সভাপতি তৈমুর রহমান বলেন, ‘আগে আন্দোলন, পরে নির্বাচন। ইতিহাস বলে যে দল আন্দোলনে সফল হয়, তারাই সরকার গঠন করে। আমরা আন্দোলনের চূড়ান্ত পর্যায়ে আছি। যেকোনো সময় সরকারের পদত্যাগ নিশ্চিত। আর তখন যেন নির্বাচনে বেগ পেতে না হয়, সে জন্য দলও গুছিয়ে রাখছি।’

অন্য দলগুলোও তৎপর

ঠাকুরগাঁও-১ ও ৩ আসনে বরাবরই বিএনপির প্রার্থীকে সমর্থন দিয়ে আসছে জামায়াত। বদলে ঠাকুরগাঁও-২ আসনটি জামায়াতকে ছেড়ে দেয় বিএনপি। তবে এবার তিনটি আসনেই তৎপরতা চালাচ্ছেন জামায়াতে ইসলামীর নেতারা। ঠাকুরগাঁও-১ আসনে ইসলামী ছাত্রশিবিরের সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি মো. দেলওয়ার হোসেন, ঠাকুরগাঁও-২ আসনে জেলা জামায়াতের আমির আবদুল হাকিম ও ঠাকুরগাঁও-৩ আসনে জেলা জামায়াতের নায়েবে আমির বেলাল উদ্দীন প্রধান দেয়ালে দেয়ালে পোস্টার সাঁটিয়েছেন।

ঠাকুরগাঁও-১ আসনে ওয়ার্কার্স পার্টি থেকে জেলা আইনজীবী সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক ইমরান হোসেন চৌধুরী ও ঠাকুরগাঁও-৩ আসনে সাবেক সংসদ সদস্য ইয়াসিন আলীও নির্বাচন করতে চান বলে দলীয় সূত্রে জানা গেছে।

জাতীয় পার্টিও মাঠে রয়েছে। ঠাকুরগাঁও-১ আসনে মনোনয়নপ্রত্যাশী দলের জেলা সাধারণ সম্পাদক রেজাউর রাজী চৌধুরী। ঠাকুরগাঁও-২ আসনে কেন্দ্রীয় ভাইস চেয়ারম্যান নুরুন নাহার বেগম এবং ঠাকুরগাঁও-৩ আসনে বর্তমান সংসদ সদস্য ও কেন্দ্রীয় ভাইস চেয়ারম্যান হাফিজ উদ্দিন আহম্মেদ মনোনয়নপ্রত্যাশী। হাফিজ উদ্দিন বলেন, ‘এলাকার জনগণ লাঙ্গলে ভোট দিতে চায়। গত নির্বাচনে তার প্রমাণ মিলেছে। সেই কথা ভেবে এবারের নির্বাচনের প্রস্তুতি আমরা নিয়ে রেখেছি।’