২৫ বছর আগে হারানো ছেলেকে ফিরে পেয়ে আনন্দে বুকে জড়িয়ে ধরলেন বাবা

২৫ বছর আগে হারিয়ে যাওয়া ছোট ছেলেক ফিরে পেলেন আবদুস সামাদ। আজ কুড়িগ্রামের নাগেশ্বরীর সরকারটারী গ্রামে
ছবি: সংগৃহীত

কুড়িগ্রামের নাগেশ্বরীর বাসিন্দা মো. আবদুস সামাদ। ২৫ বছর আগে তাঁর দুই ছেলে মায়ের সঙ্গে ঢাকায় গিয়ে হারিয়ে যায়। অনেক খোঁজাখুঁজির পর একসময় তাঁদের ফিরে পাওয়ার আশা ছেড়ে দেন। অবশেষে শনিবার সকালে হারিয়ে যাওয়া দুই ছেলের মধ্যে ছোট ছেলে মাইদুল ইসলাম তাঁর কাছে ফিরে এসেছেন। সঙ্গে এনেছেন তাঁর স্ত্রী ও সন্তানকেও। ২৫ বছর পর হারানো ছেলেকে ফিরে পেয়ে আনন্দে আত্মহারা আবদুস সামাদ। সকাল থেকে দলে দলে মানুষ মাইদুলকে দেখতে তাঁদের বাসায় ভিড় করছেন।

উপজেলার সন্তোষপুর ইউনিয়নের উত্তর সরকারটারী গ্রামের ঘটনা এটি। তবে ছোট ছেলে বাড়ি ফিরে এলেও আবদুস সামাদের বড় ছেলে মতিয়ার রহমান এখনো নিখোঁজ।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, নিখোঁজ ব্যক্তিদের তাঁদের পরিবারের সঙ্গে মিলিয়ে দেওয়ার ইউটিউবভিত্তিক উদ্যোগ আপন ঠিকানা আবদুস সামাদ ও তাঁর ছেলে মাইদুলকে এক করেছে। এ জন্য ওই সংগঠনের প্রতি আজীবন কৃতজ্ঞ থাকবেন বলে জানান বাবা-ছেলে।

পরিবারটি সূত্রে জানা যায়, মাইদুল ইসলাম ও মতিয়ার রহমানের বয়স যখন ৫ ও ১০ বছর, তখন পারিবারিক দ্বন্দ্বে তাঁদের বাবা মো. আবদুস সামাদের সঙ্গে মা মোছা. বানেছা বেগমের বিচ্ছেদ হয়। পরে মা বানেছা বেগম অন্যত্র বিয়ে করে মাইদুল ও মতিয়ার রহমানকে নিয়ে ঢাকা চলে যান। ঢাকায় বানেচা বেগম দ্বিতীয় স্বামীকে নিয়ে সংসার পাতলেও দুই ছেলের ঠাঁই হয় অন্যের বাড়িতে। অল্প কিছুদিনের মধ্যে ওই বাড়ির মালিক চুরির অপবাদ দিয়ে দুই ভাইকে বাড়ি থেকে বের করে দেন। পরে দুই ভাই ওই বাড়ি থেকে বের হয়ে মাকে খুঁজতে খুঁজতে হারিয়ে যান। এরপর আর দুই ভাইয়ের দেখা হয়নি।

আমি প্রতিদিন তাহাজ্জুদের নামাজ শেষে আল্লাহর কাছে দোয়া করে ছেলেকে ফেরত চাইছি। আল্লাহ আমার দোয়া কবুল করেছেন। আজ আমার ছোট ছেলে মাইদুল বউ ও নাতি নিয়ে বাসায় ফিরেছে। আল্লাহ পাক যদি বড় ছেলে মতিয়ারকে ফিরিয়ে দেন, আমার আর কোনো চাওয়া-পাওয়া নেই।
আবদুস সামাদ, মাইদুল ইসলামের বাবা

মাইদুল এক বন্ধুর মাধ্যমে সম্প্রতি ‘আপন ঠিকানা’র সন্ধান পান। সেখানে যোগাযোগ করেন নিজের মা–বাবাকে খুঁজে পেতে। আপন ঠিকানার ভিডিও ইউটিউবে চলতি মাসে প্রচার হওয়ার পর মাইদুলের মা বানেছা বেগম প্রথম দেখেন। পরে তিনি মাইদুলের বাবার সঙ্গে যোগাযোগ করেন। মাইদুলের বাবা আবদুস সামাদ  ও চাচা মো. রফিকুল ইসলাম ঢাকায় গিয়ে আপন ঠিকানায় যোগাযোগ করেন। আপন ঠিকানা মাইদুলের সঙ্গে তাঁদের সাক্ষাত করিয়ে দেন।

মাইদুলের এক মেয়ে ও এক ছেলে। ছেলের বয়স ৭ বছর ও মেয়ের বয়স দেড় বছর। মাইদুল ঢাকায় গেন্ডারিয়া রেলস্টেশন এলাকায় ঝালমুড়ি বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করেন। তাঁর মা বানেছা বেগম ঢাকায় দ্বিতীয় স্বামীর সংসারে আছেন।

বড় ভাইকে হারিয়ে ফেলার ঘটনার স্মৃতিচারণা করে মাইদুল ইসলাম বলেন, ‘গ্রাম থেকে আমাদের দুই ভাইকে নিয়ে মা ঢাকায় চলে যাওয়ার কিছুদিন পর একজনের বাসায় আমাদের রেখেছিল। কিছুদিন পর বাড়ির মালিক আমাদের দুই ভাইকে চুরি করার অপবাদে মারপিট করে বেঁধে রাখেন। পরে ওই বাড়ির মেয়ে আমাদের ছেড়ে দিয়ে বলে, “তোমরা পালিয়ে যাও।” আমি ও ভাই বাড়ি থেকে বের হয়ে মাকে খুঁজতে খুঁজতে নিজেরাই হারিয়ে যাই। আমার বড় আশা ছিল, বাসায় ফিরে বাবা-মা ও বড় ভাইকে একসঙ্গে দেখতে পাব। বাবাকে পেলাম ঠিকই, মায়ের সঙ্গেও কথা হয়েছে। কিন্তু ভাই কোথায় আছে, জানি না। বাবা-মাকে ফিরে পেয়ে কী শান্তি পেয়েছি, তা ভাষায় প্রকাশ করতে পারব না।’

মাইদুল ইসলামের বাবা আবদুস সামাদ বলেন, ‘আমার দুই ছেলেকে হারিয়ে খুব দুশ্চিন্তায় ছিলাম। ওর মায়ের কাছে লোক পাঠিয়েছিলাম। বলে, ছেলে হারিয়ে গেছে। আমি প্রতিদিন তাহাজ্জুদের নামাজ শেষে আল্লাহর কাছে দোয়া করে ছেলেকে ফেরত চাইছি। আল্লাহ আমার দোয়া কবুল করেছেন। আজ আমার ছোট ছেলে মাইদুল বউ ও নাতি নিয়ে বাসায় ফিরেছে। আল্লাহ পাক যদি বড় ছেলে মতিয়ারকে ফিরিয়ে দেন, আমার আর কোনো চাওয়া-পাওয়া নেই।’

স্থানীয় বাসিন্দা নুর হোসেন বলেন, ‘২৫ বছর পর মাইদুলের ফিরে আসায় এলাকাবাসী ভীষণ খুশি। বাড়িটাতে যেন ঈদের আমেজ চলছে। সকাল থেকে দলে দলে মানুষ মাইদুলকে দেখতে তাঁদের বাসায় ভিড় করছেন। আমাদেরও ওই আনন্দ ছুঁয়ে যাচ্ছে।’

সন্তোষপুর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান মো. লিয়াকত আলী জানান, ‘২৫ বছর আগে হারিয়ে যাওয়া ছেলেকে ফিরে পাওয়ার ঘটনায় এলাকাবাসীর সঙ্গে আমিও আনন্দিত। আমি ঢাকায় অবস্থান করায় ওই পরিবারের কাছে যেতে পারিনি, ফোনে খোঁজ নিয়েছি। ঢাকা থেকে ফিরে ওই পরিবারের কাছে যাব। তাঁদের কোনো সহযোগিতার প্রয়োজন হলে ইউনিয়ন পরিষদ পাশে থাকবে।’