ঘটি গরম থেকে চানাচুর—৪২ বছর ধরে হকারি করেন আবদুল আলী

৪২ বছর ধরে চানাচুর বিক্রি করছেন আবদুল আলী। আগে কষ্ট না হলেও ঊর্ধ্বগতির বাজারে এখন সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন। শুক্রবার রাতে কিশোরগঞ্জ জেলা শহরের চরশোলাকিয়া কানিকাটা রেলগেট মোড়েছবি: প্রথম আলো

অভাবের সংসারে দিনমজুরি করতেন। কিন্তু সব দিন কাজ পেতেন না। ভাবলেন এমন কিছু করবেন, যা সব সময় করা যায়। পরিকল্পনামতো দিনমজুরির টাকা জমিয়ে ঘটি গরম বিক্রি করতে সিলভারের সসপেন কেনেন। পরে বিভিন্ন স্কুলের সামনে ঘটি গরম বিক্রি শুরু করেন। পাঁচ বছর পর ব্যবসার পরিধি বাড়াতে একটি ভ্যানগাড়ি নেন। চানাচুর, ছোলা-বুটের পাশাপাশি ভ্যানগাড়িতে রাখা চুলায় গরম সেদ্ধ ডিম বিক্রি শুরু করেন। এভাবে ৪২ বছর ধরে স্কুল-কলেজসহ শহরের বিভিন্ন এলাকায় হকারি করেন আবদুল আলী (৬৫)।

আলীর বাড়ি কিশোরগঞ্জ শহরতলির চরশোলাকিয়া বাকপাড়া এলাকায়। মৃত আবদুল মান্নানের ছেলে আবদুল আলী। দুই সন্তানের জনক। নিজে নিরক্ষর। বাংলায় নিজের নামও লিখতে পারেন না। অভাবের কারণে নিজে পড়াশোনা না করতে পারলেও জীবনের অনেক সময় কেটেছে স্কুল-কলেজের সামনে চানাচুর বিক্রি করে। সেই থেকে মনস্থির করেন, যত কষ্ট হোক দুই ছেলেমেয়েকে পড়াশোনা করাবেন। ছেলেমেয়ে দুজনকেই স্নাতকোত্তর পাস করিয়েছেন।

শুক্রবার দিবাগত কিশোরগঞ্জ শহরের চরশোলাকিয়া কানিকাটা মোড়ে কথা হয় আলীর সঙ্গে। রাত তখন প্রায় দেড়টা। শীতের রাতে ভ্যানগাড়ির পাশে দাঁড়িয়ে চানাচুর বিক্রির জন্য পেঁয়াজ কাটছিলেন। জানালেন, নাম আবদুল আলী হলেও সবাই তাঁকে কালা ভাই হিসেবে চেনেন। অনেকে সংক্ষেপে আলী ভাই বলেও ডাকেন। প্রথম গলায় সসপেন ঝুলিয়ে ঘটি গরম বিক্রি করলেও এখন ভ্যানগাড়িতে চানাচুর ও বুটের পাশাপাশি ডিমও বিক্রি করেন। নিজের আয় দিয়ে দুই ছেলেমেয়েকে পড়িয়েছেন। শহরে তিন শতক জায়গা কিনে বাড়িও করেছেন। আগে সংসার চালাতে কষ্ট না লাগলেও বর্তমান দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে।

আবদুল আলী প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর বয়স যখন ২০ তখন তিনি অন্যের জমিতে শ্রমিকের কাজ করতেন। বিনিময়ে প্রতিদিন ১৫ টাকা করে পেতেন। তবে সব দিন কাজ পেতেন না। অভাবী পরিবারে জন্ম নেওয়ায় কাজ না করে বসে থাকলে খাওয়াদাওয়ায় কষ্ট হতো। তাই চিন্তা করেন, প্রতিদিন করা যায় এমন কাজ করবেন। একদিন এক লোককে স্কুলের সামনে আঁচার বিক্রি করতে দেখে ভাবনা আসে, তিনিও স্কুলের সামনে কিছু একটা করবেন। এরপর প্রতিদিন দুই-তিন টাকা করে জমাতে থাকেন। ১২০ টাকা জমানোর পর ৩০ টাকা দিয়ে একটি টিন তৈরি করেন। ঘটি গরমের সিলভারের সসপেন বানাতে লাগে আরও ৭০ টাকা। বাকি ২০ টাকা দিয়ে চানাচুর, বুট, বাদাম আর পেঁয়াজ-মরিচ কিনে বিক্রি শুরু করেন।

আলী আরও বলেন, গলায় ঘটি গরমের টিন আর সসপেন ঝুলিয়ে প্রায় পাঁচ বছর চানাচুর বিক্রি করেন। কিন্তু গলায় টিন আর সসপেন ঝুলিয়ে বিক্রি করতে কষ্ট হচ্ছিল। পাঁচ বছর পর জমানো টাকা দিয়ে একটি ভ্যানগাড়ি বানান। ব্যবসার পরিধিও বাড়িয়ে ভ্যানগাড়িতে রাখা চুলায় সেদ্ধ ডিম বিক্রি শুরু করেন। এভাবে ৪২ বছর ধরে স্কুল–কলেজের সামনেসহ শহরের রাস্তার বিভিন্ন মোড়ে দাঁড়িয়ে চানাচুর বিক্রি করে আসছেন।

আবদুল আলী প্রথম আলোকে বলেন, ‘ছোডবেলায় অনেক কষ্ট করছি। অভাবের জন্য নিজেরা লেহাপড়া করতে না ফারলেও কষ্ট হইলেও ছেলেমেয়েদের ফরাইছি। বুড়া বয়সে শীতের এই সময়ে এহনো অনেক রাইত পর্যন্ত চানাচুর আর ডিম বেচি। আল্লাহর রহমতে সেই যে ৪২ বছর আগে থেকে চানাচুর বেচা আরম্ভ করছিলাম। এরপর আর থামিনি। তাঁর আক্ষেপ, ছেলেমেয়েকে অনেক কষ্ট করে মাস্টার্স পর্যন্ত পড়ালেখা করানোর পরও চাকরি হচ্ছে না। ছেলেটির ভালো একটা চাকরি হলে তাঁর বৃদ্ধ বয়সের দুঃখ ঘুচে যেত।

স্থানীয় কানিকাটা এলাকার বাসিন্দা তারা মিয়া বলেন, ‘আলী ভাই আমরার সমবয়সী। একসঙ্গে জমিতে কাজ করেছি। নিজ চোখে দেখেছি, কত কষ্ট করে দুই ছেলেমেয়েকে পড়িয়েছে, যেটা এলাকার অনেক টাকাওয়ালা মানুষও করতে পারেনি। তিনি একজন গর্বিত পিতা। আমরা সবাই তাঁকে সম্মান করি।’