মুন্সিগঞ্জে ১০ কোটি টাকার পানি শোধনাগার পড়ে আছে

শোধনাগারটি পড়ে থাকায় পানি পচে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। কাঠামো ও পানিতে ভারী শ্যাওলা জমে আছে। পানিতে ব্যাঙ দৌড়াচ্ছে।

কাজ শেষ হলেও পানি শোধনাগারটি বুঝে নিচ্ছে না পৌর কর্তৃপক্ষ। মুন্সিগঞ্জ শহরের হাটলক্ষীগঞ্জ এলাকায়ছবি: প্রথম আলো

তিন দফা মেয়াদ বাড়িয়ে গত বছর শেষ করা হয়েছিল মুন্সিগঞ্জ পৌরসভার ভূপৃষ্ঠস্থ পানি শোধনাগার প্রকল্পের কার্যক্রম। কয়েক মাস পরীক্ষামূলকভাবে পানি শোধনের কাজও চলে। তবে প্রকল্পটি হস্তান্তর নিয়ে ঠিকাদার, জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর ও পৌরসভার মধ্যে সমন্বয়হীনতা দেখা দিয়েছে। এর মধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে সোয়া ১০ কোটি  টাকা ব্যয়ে নির্মিত পানি শোধনাগারটি।

প্রকল্পের ঠিকাদার ও মুন্সিগঞ্জ জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, ৩৭ জেলা শহরে পানি সরবরাহ প্রকল্পের অধীনে ২০১৮ সালের ১১ এপ্রিল ইউনুস অ্যান্ড ব্রাদার্স নামে একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে মুন্সিগঞ্জ শহরের হাটলক্ষীগঞ্জ এলাকায় পানি শোধনাগার নির্মাণের দায়িত্ব দেওয়া হয়। এতে ব্যয় ধরা হয় ১০ কোটি ২৬ লাখ ৯০ হাজার ২৩৭ টাকা। ২০১৯ সালের মে মাসে কাজ শেষে প্রকল্পটি বুঝিয়ে দেওয়ার কথা ছিল ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের। তবে জমি নিয়ে জটিলতার কারণে ঠিকাদার কাজই শুরু করেন ২০১৯ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর। পরবর্তী সময়ে আরও ১৩ মাস বাড়িয়ে ২০২০ সালের জুন পর্যন্ত সময় দেওয়া হয় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে। তবে নির্মাণের শুরুতেই নিম্নমানের পাইপ ব্যবহার করা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে।

পরে আরেক দফা বাড়িয়ে ২০২১ সালের জুলাই পর্যন্ত সময় নেয় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। অবশেষে ২০২৩ সালের জুলাইয়ে প্রকল্পের কাজ শেষ হয়। সে বছর আগস্ট থেকে পানির নমুনা পরীক্ষার জন্য পরবর্তী তিন মাস সচল ছিল। তবে ঠিকাদারদের থেকে প্রকল্পের কাজ বুঝে না নেওয়ায় বন্ধ পড়ে আছে পানি বিশুদ্ধকরণ কার্যক্রম।

হাটলক্ষ্মীগঞ্জ এলাকার সাকিব আহমেদ বলেন, ‘কয়েক মাস পানি শোধনাগারটি চালিয়েছিল। আমরা বিশুদ্ধ পানির পাব আশা করছিলাম। এখন আবার বন্ধ, তাহলে এত টাকা দিয়ে এটি করে লাভ কী?’

গত বুধবার সরেজমিনে দেখা যায়, ৩৩০০ বগর্ফুট জায়গাজুড়ে নির্মিত পানি শোধনাগারটির কার্যক্রম পুরোপুরি বন্ধ রয়েছে। শোধনাগারটি পড়ে থাকায় পানি পচে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। কাঠামো ও পানিতে ভারী শ্যাওলা জমে আছে। পানিতে ব্যাঙ দৌড়াচ্ছে।

শোধনাগার দেখভালের দায়িত্বে থাকা পাহারাদার অনিল বর্মণ জানান, কয়েক মাস আগে পরীক্ষামূলক পানি ওঠানো হয়েছিল। জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর কাজ বুঝে না নেওয়ায় ঠিকাদার কাজ বন্ধ রেখেছেন। তাই হাউসের পানিতে ব্যাঙ, শ্যাওলা জন্মেছে।

পরিকল্পনা ছিল শোধনাগারটির মাধ্যমে পাশের ধলেশ্বরী নদী থেকে পানি উত্তোলন করে প্রতি ঘণ্টায় ৩ লাখ ৫০ হাজার লিটার পানি বিশুদ্ধ করা হবে, যা সরবরাহ করা হবে মুন্সিগঞ্জ পৌরসভায়।

হাটলক্ষ্মীগঞ্জ এলাকার বেশ কয়েকজন নারী-পুরুষের সঙ্গে কথা হয়। তাঁরা জানান, ৮–১০ বছর আগে নদী ও অগভীর নলকূপের পানি দিয়ে গৃহস্থালির কাজ চলত। কয়েক বছর ধরে ধলেশ্বরী তীরের সিমেন্ট কারখানাসহ বিভিন্ন শিল্পপ্রতিষ্ঠানের দূষণে নদীর পানি ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে গেছে। নলকূপেও ঠিকমতো পানি পাওয়া যাচ্ছে না। নলকূপে পানি উঠলেও অসহনীয় মাত্রায় আর্সেনিক থাকে। তাই পানি শোধনাগারটি পৌরবাসীর জন্য খুব প্রয়োজনীয়।

মুন্সিগঞ্জ নাগরিক সমন্বয় পরিষদের আহ্বায়ক সুজন হায়দার বলেন, ‘প্রকল্পটি পৌরবাসীর কোনো কাজে লাগছে না। সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোর খামখেয়ালিপনার নিরসন করে প্রকল্পের সেবা শহরবাসীর কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য পানি শোধনাগারটি শুরু করার জোর দাবি জানাচ্ছি।’

প্রকল্পটির কাজ করতে গিয়ে অনেক ভুগতে হয়েছে মন্তব্য করে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের মালিক মোহাম্মদ মাসুদুর রশিদ বলেন, ‘জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরকে কাজ বুঝে নিতে একাধিকবার লিখিত ও মৌখিকভাবে জানালেও তারা জানিয়েছে পৌরসভা প্রকল্পটি নিতে চাইছে না। জনস্বাস্থ্য অধিদপ্তরও প্রকল্পটি নিচ্ছে না। এমনিতেই এ কাজে দেড় কোটি টাকার বেশি লোকসান হয়েছে। এক মাস পানি শোধন করতে এক লাখ টাকা খরচ হয়। তাই কাজ বন্ধ রেখেছি।’ 

ঠিকাদারের অভিযোগ, পৌরসভার কয়েকজন প্রভাবশালী এ কাজটি করতে চেয়েছিলেন। কাজটি তাঁরা না পাওয়ায় জনস্বাস্থ্য প্রকৌশলের সঙ্গে যোগসাজশ করে পৌর কর্তৃপক্ষ প্রকল্প বুঝে নিচ্ছে না। 

জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী হুমায়ুন কবীরের মুঠোফোনে একাধিকবার কল করা হলেও তিনি ধরেননি। তবে মুন্সিগঞ্জ জনস্বাস্থ্য অধিদপ্তরের উপসহকারী প্রকৌশলী এস এম আবদুর রহমান বলেন, প্রকল্পটি যৌথভাবে পৌরসভাকে বুঝিয়ে দেওয়ার কথা ছিল ঠিকাদার ও জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের। পৌরসভা কাজটি বুঝে নিচ্ছে না, এ জন্য তারাও ঠিকাদারের কাছ থেকে নিতে পারছে না।

মুন্সিগঞ্জ পৌরসভার ভারপ্রাপ্ত মেয়র সোহেল রানা প্রথম আলোকে বলেন, ‘কাজ নিম্নমানের ছিল। এ জন্য সাবেক মেয়র কাজটি বুঝে নেননি। তবে আমরা শিগগিরই পানি শোধনাগারের কাজটি বুঝে নেব। এ বিষয়ে আমাদের আলাপ-আলোচনা চলছে।’