বন্ধ হয়ে যাওয়া সরকারি বিদ্যালয়টি এখন শিক্ষার্থীতে মুখর, কীভাবে

চার বছর বন্ধ থাকার পর আবার শিক্ষার্থীর কলরবে মুখর রংপুর নগরের কামালকাছনা এলাকার কল্যাণী সংসদ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ছবি: মঈনুল ইসলাম

শিক্ষার্থীসংকটে একসময় বন্ধ হয়ে গিয়েছিল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়টি। দায়িত্বপ্রাপ্ত শিক্ষকদের শাস্তিমূলক বদলি করা হয় অন্য বিদ্যালয়ে। চার বছর পর এলাকাবাসীর দাবির মুখে আবার নতুন করে চালু হয়। কিন্তু এবারের গল্পটা ভিন্ন। বন্ধ বিদ্যালয় থেকে এটি হয়ে উঠেছে রংপুর নগরের প্রাণবন্ত এক সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির নাম কল্যাণ সংসদ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। প্রতিষ্ঠানটির শিক্ষক ও এলাকাবাসী বলেন, ১৯৯৫ সালে রংপুর নগরের কামাল কাছনায় এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিপি) অর্থায়নে বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠিত হয়। এই বিদ্যালয়ের উদ্বোধন করেন তখনকার শিক্ষামন্ত্রী জমির উদ্দিন সরকার।

বিদ্যালয়সংলগ্ন এলাকার বাসিন্দা ও রংপুর জিলা স্কুলের সাবেক শিক্ষক শফিকুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, শুরুর দিকে প্রাথমিক বিদ্যালয়টি ভালো চলছিল। কিন্তু পরে শিক্ষার্থী কমতে থাকায় ২০১৬ সালে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটি বন্ধের নির্দেশ দেয় প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। কিন্তু বিদ্যালয়টির বন্ধ হওয়া মানতে পারেননি স্থানীয় লোকজন।

স্থানীয় বাসিন্দা ও দাতা সদস্য মোসলেম উদ্দিন বলেন, তাঁরা বিদ্যালয়টি চালুর জন্য অধিদপ্তর ও মন্ত্রণালয়ে যোগাযোগ করেন। বিষয়টি নজরে আসে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের তখনকার মহাপরিচালক মঞ্জুর কাদিরের। তিনি বিদ্যালয়টি পরিদর্শন করে এলাকাবাসীর সঙ্গে মতবিনিময় করেন। তাঁর উদ্যোগে ২০২০ সালের ১ জানুয়ারি কল্যাণ সংসদ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আবার পাঠদান শুরু হয়।

বিদ্যালয়টিতে প্রাক্‌-প্রাথমিক থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার্থী ১২০
ছবি: প্রথম আলো

বিদ্যালয় সূত্রে জানা যায়, ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে এই বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক রোমেনা আখতার বানুসহ পাঁচ শিক্ষককে দায়িত্ব দেওয়া হয়। তাঁরা স্থানীয়ভাবে অভিভাবকদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে শিশুদের স্কুলমুখী করেন। ২০২০ সালে ওই স্কুলে ১৫০ শিক্ষার্থী ভর্তি হয়। এ বছর প্রাক্‌-প্রাথমিক থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার্থী ১২০। শিক্ষক আছেন ছয়জন।

প্রধান শিক্ষক রোমেনা আখতার বলেন, শুরুর দিকে ১৫০ শিক্ষার্থী ভর্তি হলেও বিদ্যালয়ে আসে ১১৩ জন। তাঁরা শিক্ষার্থীদের বাড়ি গেলে অভিভাবকেরা বলেন, এই বিদ্যালয় আবার বন্ধ হবে। বিদ্যালয়ে জিন-ভূতের আসর আছে। এসব পরিস্থিতির পাশাপাশি বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতিযোগিতাও মোকাবিলা করতে হচ্ছে তাঁদের।

বিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা বলেন, চার বছর বন্ধ বিদ্যালয়ে দালানের পলেস্তারা খসে পড়েছিল। টেবিল, আলমারি ভাঙা ছিল। এখন সেই করুণ দশা নেই। প্রাথমিক শিক্ষাকে আনন্দদায়ক ও মানসম্মত করতে শ্রেণিকক্ষসহ বিদ্যালয়ের পুরো ভবন সুসজ্জিত করা হয়েছে।

টিফিনের ফাঁকে খেলায় মেতেছে শিশু শিক্ষার্থীরা। ছবিটি রংপুর নগরের কামালকাছনা এলাকার কল্যাণী সংসদ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের

গত মঙ্গলবার সরেজমিনে দেখা গেছে, শ্রেণিকক্ষগুলোর নামকরণ করা হয়েছে কাজী নজরুল ইসলাম, বেগম রোকেয়া, জয়নুল আবেদীনের নামে। বিদ্যালয়ে আছে সাহিত্য, ইতিহাস, বিজ্ঞান ও মুক্তিযুদ্ধ কর্ণার।

অভিভাবক শিউলি বেগম বলেন, তাঁর ছেলে স্বাদ গত বছর এখান থেকে পঞ্চম শ্রেণি পাস করেছে। মেয়ে মুনতাহা দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ছে। তাঁর মতে, শিক্ষকেরা আন্তরিক। পিছিয়ে পড়া শিক্ষার্থীদের শিখনঘাটতি কাটাতে তাঁরা নিবিড়ভাবে সময় দেন।  

তবে প্রধান শিক্ষক রোমেনা আখতার শিক্ষার্থী ধরে রাখা নিয়ে চ্যালেঞ্জের কথাও বললেন। তিনি বলেন, ২০২৩ সালে তাঁদের বিদ্যালয়ের একজন শিক্ষার্থী নাচে জাতীয়ভাবে দ্বিতীয় হয়। কিন্তু একটি নামীদামি বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের চাপে ওই শিক্ষার্থীকে পরবর্তী সময়ে আর রাখতে পারেননি অভিভাবক।

টিফিনের ফাঁকে শিক্ষার্থীদের আনন্দ
ছবি: প্রথম আলো

জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা নজরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, শিক্ষকেরা চমৎকারভাবে বিদ্যালয়টি পরিচালনা করছেন। এটি একটি দৃষ্টিনন্দন বিদ্যালয় হয়ে উঠেছে। একই সঙ্গে অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য অনুকরণীয় হয়ে উঠেছে।