গাছে ফেটে যাওয়া লিচু দেখছেন চাষি সতীশ বর্মণ। সম্প্রতি ঠাকুরগাঁও শহরের গোবিন্দনগর এলাকায়
ছবি: প্রথম আলো

ঠাকুরগাঁওয়ে গত বছর কয়েক দফার শিলাবৃষ্টিতে ঝরে গিয়েছিল গাছের লিচু। এ বছর মুকুলের ভারে নুয়ে পড়েছিল গাছ। তা দেখে লাভের আশা করছিলেন চাষিরা। কিন্তু বৈরী আবহাওয়ায় মুকুল থেকে গুটি হতেই তার কিছু ঝরে গেছে। এরপরও গাছে যা লিচু টিকে ছিল, তীব্র তাপপ্রবাহে সেটাতেও আবার পোড়া দাগ দেখা দিয়েছে। আর এতেই ফেটে নষ্ট হয়ে গেছে গাছের অনেক লিচু। ফলে লিচুর পোড়া দাগের সঙ্গে যেন চাষিদের মনও পুড়ছে। লোকসানের আশঙ্কা করছেন চাষিরা।

ঠাকুরগাঁওয়ে প্রতিবছরই একের পর এক লিচুবাগান গড়ে উঠছে। ঠাকুরগাঁওয়ের জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর কার্যালয় তথ্য অনুসারে, জেলায় ৭০৫ হেক্টর জমিতে ২৫৬টি লিচুর বাগান আছে। আর এসব বাগান থেকে গত বছর ৫ হাজার ৫৯৮ মেট্রিক টন লিচু উৎপাদন হয়েছিল। এ ছাড়া এলাকার অনেক বাড়ির আঙিনায় ও আশপাশের ভিটায় লিচুর চাষ করা হয়।

গোবিন্দনগর, মুন্সিরহাট, নারগুন, আকচাসহ সদর উপজেলার কয়েকটি গ্রামে গোলাপি, মাদ্রাজি, বোম্বাই, বেদানা ও চায়না-৩ জাতের লিচুর চাষ হয়। এখন সেসব গ্রামে গাছে থোকা থোকা লিচু ঝুলে আছে। কোনো গাছে কেবল পাক ধরেছে। আবার কোনোটির রং এখন সবুজ। কোনো কোনো গাছের লিচুর গায়ে রোদে পোড়া দাগ। আবার কিছু লিচুর চামড়া ফেটে গেছে।

লিচুচাষিরা বলছেন, যখন গুটি থেকে আঁটিতে পরিণত হচ্ছিল, তখন লিচু ফেটে গিয়ে ভেতরের শাঁস বেরিয়ে আসে। একপর্যায়ে চামড়া শুকিয়ে নিচে পড়ে। অনেক গাছের ৪০ শতাংশ লিচু এভাবে নষ্ট হয়ে গেছে। তাঁদের ধারণা, তীব্র গরমে এমনটি হয়ে থাকতে পারে।

গোবিন্দনগর এলাকায় সতীশ বর্মণের লিচুর একটি বাগান রয়েছে। সেই বাগানে গোলাপি জাতের ২৫০টি গাছ আছে। আজ শুক্রবার বেলা ১১টার দিকে দেখা গেল, তিনি গাছের লিচু পরিচর্যায় ব্যস্ত। সতীশ বললেন, গত বছর শিলাবৃষ্টিতে গাছের লিচু ঝরে গিয়েছিল। এ বছর গাছ মুকুলে ভরে যায়। কিন্তু বৃষ্টি না থাকায় মুকুল থেকে গুটি হতেই কিছু ঝরে গেছে। মাসখানেক আগে একবার বৃষ্টি হওয়ায় গাছে থাকা লিচু দ্রুত বাড়তে থাকে। কিন্তু পরে প্রচণ্ড গরমে লিচুতে দাগ দেখা দেয়। আর এতেই গাছের অর্ধেকের বেশি লিচু ফেটে গেছে। আবার সেসব লিচু এখন মাটিতে ঝরে পড়ছে।
১৫ বছর ধরে ঠাকুরগাঁওয়ে আম-লিচুর বাগান কিনে ব্যবসা করছেন চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলার আজহারুল ইসলাম (৫৮)। তাঁর একটি বাগানে গোলাপি লিচু সংগ্রহের কাজ চলছে। একদল যুবক লিচু সংগ্রহ করে স্তূপ করে রাখছেন। আর সেসব লিচু গাছের নিচে বসে বাছাই করছেন একদল নারী-পুরুষ। সে সময় সারোয়ার হোসেন নামের একজন বললেন, এর আগে লিচুর ফলন এত খারাপ হয়নি। বাগানের ৩০ থেকে ৪০ ভাগ লিচু ফেটে গেছে। এবার ব্যবসায় অনেক লোকসান হবে।

গাছের লিচু ফেটে গেছে। সম্প্রতি ঠাকুরগাঁও শহরের গোবিন্দনগর এলাকায়
ছবি: প্রথম আলো

পাশের বাগানটি আবদুস সালামের। তাঁর বাগানে ৫৬টি গাছ রয়েছে। সালামের বাগানের গাছের লিচু আগাম কিনে নিয়েছেন ফেনীর দাগনভূঞা উপজেলার ফল ব্যবসায়ী নুর ইসলাম। তিনি বলেন, প্রতিবছর যখন লিচুগাছে মুকুল দেখা দেয়, তখন তাঁরা বাগান ঘুরে মুকুল দেখেন আর অনুমান করেন লিচুর ফলনের। পছন্দের হলে বাগানমালিকের কাছ থেকে বাগান কিনে পরিচর্যা শুরু করে দেন। এরপর লিচু পাকলে বিক্রি করে দেন দেশের বিভিন্ন এলাকার পাইকারের কাছে।

নুর ইসলাম বললেন, এ বছর গুটি ঝরে যাওয়ার পরও বাগানে গাছে গাছে প্রচুর লিচু ছিল। কিন্তু একসময় কড়া রোদ আর গরম বাতাসে তা পুড়ে যায়। পরে ঘন ঘন বৃষ্টি হওয়ায় সেই লিচু ফেটে পচে গেছে। গাছে সেচ দিয়েও রক্ষা করা যায়নি। এবার তাঁদের বড় ক্ষতি হয়ে গেল।

আকচা গ্রামের লিচুচাষি আহসান হাবিবের বাগানের লিচুও ফেটে গেছে। তিনি বলেন, গাছে লিচু ফেটে যাওয়ার কারণ গরম হাওয়া। এই গরম হাওয়া লিচুর গায়ে পড়লে লিচু শুকিয়ে যায় আর ফেটে যায়। গত বছর লিচুতে লাখ পাঁচেক টাকা লোকসান হয়েছে। এবারও লোকসান হবে। এভাবে লোকসান হলে লিচুর ব্যবসা ছেড়ে দিতে হবে।

ঠাকুরগাঁওয়ে তাপমাত্রা নিরূপণের কোনো কার্যালয় নেই। তবে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর প্রতিদিন তাপমাত্রা পরিমাপ করে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর জানায়, এ মাসের শুরুতে প্রায় প্রতিদিন বেলা ১১টার পর থেকে তাপমাত্রা ৩৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস অতিক্রম করছে। দুপুরের পর তাপমাত্রা উঠছে ৩৮ ডিগ্রির বেশি।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ঠাকুরগাঁও কার্যালয়ের উপপরিচালক সিরাজুল ইসলাম বলেন, মৌসুমের শুরু থেকে দিনে প্রচণ্ড দাবদাহ ও রাতে ঠান্ডা আবহাওয়া ছিল। এতে লিচু ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অন্যদিকে স্বাভাবিক বৃষ্টি না হওয়ায় মুকুল থেকে গুটি বের হওয়ার সময় কিছু ঝরে গেছে। এর পর থেকে চলেছে টানা দাবদাহ। ফলে পাকার আগেই গাছের কিছু কিছু লিচু ফেটে নষ্ট হয়ে যায়। এরপরও গাছে যে পরিমাণ লিচু টিকে রয়েছে, তাতে চাষির খুব একটা ক্ষতি হবে না।