পটুয়াখালী জেলার মানচিত্র

পটুয়াখালীর কলাপাড়ার নীলগঞ্জ ইউনিয়নের দৌলতপুর গ্রামটি সাগর থেকে খুব বেশি দূরে নয়। অতিরিক্ত লবণাক্ততার কারণে অনেক জমিই ফাঁকা থাকে। ওই গ্রামের কিছু জমিতে এবার পরীক্ষামূলকভাবে লবণসহিষ্ণু গম চাষ করা হয়েছিল। প্রথমবারেই ভালো ফলন হয়েছে। শুধু ভালোই নয়, প্রত্যাশার চেয়েও বেশি। এ কারণে এই গম নিয়ে সুন্দর ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখছের এই উপজেলার কৃষকেরা। পতিত জমিতে গম উৎপাদন করে দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে চান তাঁরা।

চলতি মাসের শুরুর দিকে দৌলতপুর গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, বিস্তীর্ণ এলাকার ফসলের খেত ফাঁকা। কিছু জমিতে লাগানো হয়েছিল সোনালি রঙের গমগাছ। বিনা চাষে এসব জমিতে গম লাগিয়েছিলেন স্থানীয় কয়েকজন কৃষক। 

লবণাক্ততার কারণে পতিত পড়ে থাকা জমি আবাদের আওতায় আনতে পাঁচ বছর ধরে কাজ করছেন অস্ট্রেলিয়া ও বাংলাদেশের গবেষকেরা। এরই ধারাবাহিকতায় এবার দৌলতপুর গ্রামে ২৮ জন কৃষক তাঁদের ২৮ বিঘা পতিত জমিতে বিনা চাষে গমের আবাদ করেছেন। তাঁদের গমের খেত এখন সোনালি রং ধরেছে। প্রতি বিঘা খেতে ৪০০ থেকে ৫০০ কেজি গমের ফলন হয়েছে। কৃষকেরা ২৮ বিঘা খেত থেকে ১১ মেট্রিক টনের বেশি গম পেয়েছেন। 

৬ মার্চ কৃষকেরা তাঁদের খেতের গম কেটে ঘরে তুলেছেন। ফসল কর্তন অনুষ্ঠানে পটুয়াখালী–৪ আসনের সংসদ সদস্য মো. মুহিব্বুর রহমান, বাংলাদেশ গম ও ভুট্টা গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক গোলাম ফারুক, ইউনিভার্সিটি অব ওয়ের্স্টান অস্ট্রেলিয়ার ডেপুটি প্রজেক্ট লিডার এম জি নিয়োগী, নীলগঞ্জ ইউপি চেয়ারম্যান বাবুল মিয়াসহ আরও অনেকে উপস্থিত ছিলেন। 

গম কাটার ফাঁকে ফাঁকে কথা হয় কৃষকদের সঙ্গে। এলাকার কৃষক মজিবুর রহমান (৫৮) জানান, তাঁর ১০ বিঘা ফসলের খেত রবি মৌসুমে পতিত থাকে। লবণাক্ততা ও মিঠাপানির অভাবে আমন ছাড়া অন্য ফসল হয় না তাঁর খেতে। কিন্তু এবার পরীক্ষামূলকভাবে এক বিঘা জমিকে বিনা চাষপদ্ধতিকে গমের আবাদ করেছেন। এতে তিনি ৪০০ কেজির বেশি গম উৎপাদন করেছেন বলে জানান।

বাংলাদেশ গম ও ভুট্টা গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক গোলাম ফারুক বলেন, আসলে দেশে দিন দিন গমের চাহিদা বাড়ছে। এই মুহূর্তে দেশে গমের চাহিদা ৭৫ লাখ মেট্রিক টন। কিন্তু উৎপাদিত হচ্ছে ১২ লাখ মেট্রিক টন। বাকি গম বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানি করতে হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, ‘লবণাক্ততার কারণে দক্ষিণাঞ্চলের কয়েক লাখ হেক্টর জমি পতিত থাকে। অস্ট্রেলিয়া ও বাংলাদেশের এই প্রকল্পের মাধ্যমে গবেষকেরা অধিক লবণসহিষ্ণু গমের জাত উদ্ভাবনের জন্য কাজ করছেন। এর মধ্যে বারি গম ২৫, বারি গম ৪ অধিক লবণসহিষ্ণু গমের জাত। এই এলাকায় কৃষক বিনা চাষে গমের আবাদ শুরু করেছে। এতে খরচ খুবই কম, লাভ বেশি। আমাদের পরিকল্পনা রয়েছে এই অঞ্চলে বিনা চাষে গমের আবাদ ও অধিক লবণসহিষ্ণু গমের জাত আরও বেশিসংখ্যক কৃষকের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়ার।

 পটুয়াখালীর কৃষি বিভাগ সূত্র জানায়, জেলায় রবি মৌসুমে লবণাক্ততার কারণে ৩১ হাজার ৫৮৯ হেক্টর আবাদি জমি পতিত রয়েছে। 

ইউনিভার্সিটি অব ওয়েস্টার্ন অস্ট্রেলিয়ার ডেপুটি প্রজেক্ট লিডার এম জি নিয়োগী বিনা চাষে গমের আবাদ প্রসঙ্গে বলেন,  উপকূলের পতিত লোনা জমিতে আমন ধান কাটার ২০-২৫ দিন আগেই গত ১৪ নভেম্বর এই এলাকার ২৮ জন কৃষক তাঁদের আমন খেতে বিঘাপ্রতি ১৬ কেজি গমের বীজ ছিটিয়ে দেয়। এ সময় জমির মাটি কিছুটা ভিজা ছিল ও জমিতে লবণাক্ততা অনেক কম ছিল। গমবীজ ছিটানোর তিন-চার দিনের মধ্যেই গমবীজগুলো ভালোভাবে গজাতে শুরু করে। খেতে উপরি সার দেওয়া হলো। পাশের পুকুর থেকে সেচ দেওয়া হলো। অতিরিক্ত বৃষ্টির পানি যেন জমির ফসল নষ্ট করতে না পারে, সে জন্য আগে থেকেই নিষ্কাশনব্যবস্থা ছিল। এখন সেই ২৮ জন কৃষকের খেত থেকে আজ সোনালি গম কেটে ঘরে তুলছেন। 

শুষ্ক মৌসুমে এই অনাবাদি জমিকে আবাদের আওতায় আনতে অস্ট্রেলিয়ার সেন্টার ফর ইন্টারন্যাশনাল অ্যাগ্রিকালচার রিসার্চ (এসিআইএআর) এবং বাংলাদেশের কৃষি গবেষণা ফাউন্ডেশনের অর্থায়নে ইউনিভার্সিটি অব ওয়েস্টার্ন অস্ট্রেলিয়া, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট, বাংলাদেশ গম ও ভুট্টা গবেষণা ইনস্টিটিউট এবং বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় যৌথ প্রকল্পের আওতায় ২০১৭ সাল থেকে গবেষণা করে আসছে।