‘জানালার গ্লাস ভেঙে বের হয়েছিলাম, সেদিনের কথা ভুলতে পারছি না’

আহত ফয়সাল মণ্ডলছবি: প্রথম আলো

‘আগুনের কারণে প্রচুর ধোঁয়া ছিল। অন্ধকারে কিছু দেখা যাচ্ছিল না। শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল। ভবন থেকে বের হতে কয়েকজন মিলে একটি দেয়াল ও জানালার গ্লাস ভেঙেছিলাম। পরে সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামতে গিয়ে আমার হাত, পা ও শরীরের কিছু অংশ পুড়ে যায়। এরপর নিচে নেমে কিছু দূর হেঁটে সড়কের ওপর পড়ে গিয়েছিলাম। সেখান থেকে একজন অজ্ঞাতনামা নারী আমাকে আর মাহবুবকে পানি পান করান এবং প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে সিএনজিতে তুলে দেন।’

আজ শনিবার বিকেলে কথাগুলো বলছিলেন কুষ্টিয়া কুমারখালী উপজেলার জগন্নাথপুর ইউনিয়নের চর ভবানীপুর গ্রামের ওয়াজেদ আলীর ছেলে ফয়সাল মণ্ডল (১৮)। ২০ জুলাই কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময় সহিসংতায় নারায়ণগঞ্জের চিটাগাং রোড এলাকায় একটি ১০ তলা ভবনে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। ওই ভবনে কাজ করছিলেন ফয়সালসহ কয়েকজন। এতে কুমারখালীর দুজনসহ তিনজন মারা যান। ফয়সাল আহত হন।

ফয়সাল মণ্ডল বলেন, সিএনজিচালিত অটোরিকশায় করে ওই রাতেই সাভার এলাকায় এক আত্মীয়ের বাড়িতে আশ্রয় নেন। সেখান থেকে ২১ জুলাই অ্যাম্বুলেন্সে কুষ্টিয়া মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পৌঁছান।

সেদিনের ঘটনার বর্ণনা দিয়ে আহত ফয়সাল বলেন, ‘আমরা ১৪ জন ভবনে কাজ করছিলাম। দুপুরেই ভবনের বাইরে থেকে শুধু গুলির আওয়াজ আসছিল। আর বিকেলে ভবনের গেটে আগুন দিয়েছিলেন বিক্ষোভকারীরা।’

ফয়সাল বলেন, ‘অনেক স্বপ্ন নিয়ে গ্রাম ছেড়ে শহরে জীবিকার পথ বেঁচে নিয়েছিলাম। এখন শুধু হতাশা আর আতঙ্ক। কোনোভাবেই ভুলতে পারছি না সেদিনের ঘটনা।’

আগুনে পুড়ে আহত মাহবুব বিশ্বাসের (১৬) বাড়িও একই এলাকায়। মাহবুব কুমারখালী উপজেলার জগন্নাথপুর ইউনিয়নের চর ভবানীপুর গ্রামের কৃষক আক্কাছ বিশ্বাসের ছোট ছেলে।

দোচালা টিনশেডের মাটির ঘরে বিছানায় শুয়ে আক্ষেপ করে মাহবুব বিশ্বাস বলেন, ‘পড়াশোনার পাশাপাশি দুলাভাইয়ের সঙ্গে কাজে গিয়েছিলাম। কিন্তু ওরা আগুন লাগিয়ে পুড়িয়ে দিল শরীরের বিভিন্ন অংশ।’

সেদিনের আগুনে পুড়ে মারা গেছেন মাহবুবের দুলাভাই ওহাব মণ্ডলের ছেলে সেলিম মণ্ডল (২৮), স্বজন মৃত সাবের আলীর ছেলে আবদুস সালাম (২৪)। এই ঘটনায় মাহবুব, ফয়সাল ছাড়াও আহত হয়েছেন প্রতিবেশী কাদেরের ছেলে পারভেজ, আবুল হোসেনের ছেলে আবদুল হামিদ। হামিদ ঢাকায় একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। তাঁরা সবাই ইউনিয়নের চর ভবানীপুর গ্রামের বাসিন্দা।

মাহবুব বলেন, ‘একফোঁটাও ঘুমাতে পারছি না। চোখ বুজলেই ভেসে উঠছে সেদিনের দৃশ্য। আগুনের কালো ধোঁয়া। কানে বাজছে গুলির শব্দ। বিশ্বাসই হয় না যে এখনো বেঁচে আছি।’

আহত ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নারায়ণগঞ্জের চিটাগাং রোড এলাকায় একটি ১০ তলা ভবনের দ্বিতীয় তলায় একটি বেসরকারি ব্যাংকের শাখায় সাজসজ্জার কাজ করছিলেন মাহবুব, সেলিম, সালাম, ফয়সাল, হামিদ, পারভেজসহ অন্তত ১৪ জন। ভবনটিতে একটি পুলিশ ক্যাম্প রয়েছে। আর নিচতলায় ছিল বিপণিবিতান। বিক্ষোভকারীরা ভাঙচুর ও আগুন দেওয়ার পাশাপাশি মাহবুব ও ফয়সালের মুঠোফোন কেড়ে নিয়ে মারধর করেন। পরে শ্রমিক পরিচয় দিয়ে রক্ষা পান তাঁরা। এরপর বিকেল ৪টার দিকে ভবনের বাইরে থেকে বিক্ষোভকারীরা ইটপাটকেল নিক্ষেপ শুরু করেন। শোনা যায় গুলির শব্দও। পরে বিকেল সাড়ে ৪টায় ব্যাংকের প্রবেশপথে পেট্রল ঢেলে আগুন ধরিয়ে দিলে ঘটে ভয়াবহ দুর্ঘটনা।

মাহবুবের বাবা আক্কাছ বিশ্বাস বলেন, ‘ওরা তো আন্দোলনে ছিল না। সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ। আগুনে পুড়ে আমার দুই মেয়েজামাই মারা গেছে। ছেলে ও আত্মীয়রা আহত হয়েছে। আমি এর সুষ্ঠু বিচার ও ক্ষতিপূরণ চাই।’