‘লাইনে দাঁড়ায় থাকতে থাকতে জীবনড্যা শ্যাষ’

টিসিবির লাইনে পণ্য কিনতে ভিড় করেন স্বল্প আয়ের মানুষ। গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে গাজীপুরের বোর্ড বাজার এলাকায়
ছবি: আল-আমিন

গতকাল মঙ্গলবার বেলা একটা। মাথার ওপর খররোদ। ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের পাশে বোর্ডবাজার এলাকায় স্থানীয় ৩৫ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলরের কার্যালয় থেকে বিক্রি করা হচ্ছে টিসিবির পণ্য। কার্যালয়টির ভেতর ও বাইরে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছেন প্রায় ৫০০ মানুষ। কারও হাতে পলিথিন, কারও হাতে ব্যাগ, কারওবা বস্তা। কেউ মাথায় ছাতা ধরে, কেউবা কাপড় রেখে সইয়ে নিচ্ছেন রোদের উত্তাপ। তবে সবার অপেক্ষা কার্যালয় থেকে দেওয়া পণ্যের জন্য।

কার্যালয়টি থেকে স্বল্পমূল্যে বিতরণ করা হচ্ছিল টিসিবির (ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ) তেল, ডাল, চিনি ও ছোলা। তাই বাজারের স্বাভাবিক দামের চেয়ে কিছুটা কম দামে পণ্য কিনতে সকাল থেকে কার্যালয়টির সামনে জড়ো হন তাঁরা। বেলা বাড়ার সঙ্গে বাড়তে থাকে মানুষ, বড় হয় লাইন।

টিসিবি কর্তৃপক্ষ জানায়, দেশে চলমান দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে তাদের পণ্যের চাহিদা আগের চেয়ে বেড়েছে। কিছুদিন আগেও যে পণ্যের খুব একটা কদর ছিল না, তা এখন বিক্রি হচ্ছে অনেকাংশে। সমাজের এক শ্রেণির মানুষ টিসিবির পণ্য পছন্দ করতেন না বা সেভাবে আগ্রহ ছিল না, কিন্তু এখন তাঁরাও নিয়মিত আসছেন স্বল্পমূল্যে পণ্য কিনতে। এসব কারণে ক্রমেই বাড়ছে তাদের গ্রাহকসংখ্যা।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গাজীপুরে টিসিবির গ্রাহক আছেন প্রায় ২ লাখ ১৮ হাজারের মতো। একজন নির্দিষ্ট ডিলারের মাধ্যমে জেলার বিভিন্ন অঞ্চলে পণ্য বিতরণ করা হয়। নিয়ম অনুযায়ী, একজন ক্রেতা সর্বোচ্চ ২ কেজি মসুরের ডাল, ২ কেজি সয়াবিন তেল, ১ কেজি চিনি ও ১ কেজি ছোলা কিনতে পারবেন। এর মধ্যে ছোলা কেজিপ্রতি ৫০ টাকা, ডাল ৭০, তেল ১১০ ও চিনি বিক্রি হয় ৬০ টাকায়। মহানগর বা উপজেলা পর্যায়ের কিছু নির্দিষ্ট এলাকায় মাসে একবার এসব পণ্য বিক্রি করা হয়। আগে এসব পণ্যের প্রতি মানুষের খুব একটা চাহিদা না থাকলেও এখন তা বেড়েছে কয়েক গুণ।

টিসিবির পণ্য মনিটরিংয়ের দায়িত্বে থাকা একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রতিটি এলাকার স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সদস্য, চেয়ারম্যান বা সংশ্লিষ্ট জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে টিসিবির গ্রাহক বানানো হয়। গ্রাহক পেতে আগে একটা সময় এলাকায় মাইকিংও করা হতো। কিন্তু এখন মানুষ নিজেরাই স্বল্পমূল্যে পণ্য নিতে আগ্রহী। একটা নির্দিষ্ট কার্ডের মাধ্যমে সমাজের নিম্নআয়ের মানুষকে এ সুবিধা দেওয়া হয়।

আগে আমরা মালামাল নিয়া সারা দিন বইস্যা থাকতাম। তাও সব মালামাল বিক্রি হইতো না। আর এহন মানুষই আমাগোরে খুঁজে। কার্ড ছাড়াও পণ্য কিনতে বইস্যা থাকে।
মো. মেহেদী হাসান, ডিলার

মো. মেহেদী হাসান নামের এক ডিলার বলেন, ‘আগে আমরা মালামাল নিয়া সারা দিন বইস্যা থাকতাম। তাও সব মালামাল বিক্রি হইতো না। আর এহন মানুষই আমাগোরে খুঁজে। কার্ড ছাড়াও পণ্য কিনতে বইস্যা থাকে।’

কথা হয় নগরের কলমেশ্বর এলাকার বাসিন্দা লাকি বেগমের সঙ্গে। পণ্য কিনতে সকাল আটটায় এসে লাইনে দাঁড়ান তিনি। দীর্ঘ অপেক্ষার পর বেলা দুইটার দিকে পণ্য পান তিনি। লাকি বলছিলেন, ‘লাইনে দাঁড়ায় থাকতে থাকতে জীবনড্যা শ্যাষ। অনেক কষ্ট কইর‌্যা শেষ পর্যন্ত কিনতে পারছি। আগে এত কষ্ট হইতো না। এহন সবার মাঝেই হাহাকার।’

একই এলাকার বাসিন্দা মো. কামাল হোসেন বলেন, ‘আগে এত ভিড় ছিল না। সবকিছুর দাম বাড়ায় এহন প্রচুর মানুষ আসতাছে। যারা বড়লোক, তারাও তদবির কইর‌্যা কার্ড করতাছে। অনেক সময় সারা দিন লাইনে দাঁড়ায় থাকার পরও জিনিস পাওয়া যায় না। যত জ্বালা আমাদের মতো গরিব মানুষের।’

টিসিবির পণ্য কিনতে মানুষের ভিড়। গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে গাজীপুরের বোর্ড বাজার এলাকায়
ছবি: প্রথম আলো

একই দিন নগরের ধীরাশ্রম, টঙ্গীবাজার ও জয়দেবপুর শহর এলাকায় ঘুরে প্রতিটি টিসিবির পণ্য বিতরণকেন্দ্রের সামনে এমন ভিড় দেখা যায়। পণ্য কেনার জন্য ভোর থেকেই মানুষ ভিড় করতে থাকেন। এর মধ্যে দীর্ঘক্ষণ লাইনে দাঁড়িয়ে থেকে তাঁরা নিজেরাই অনেক সময় ঝগড়া, কথা-কাটাকাটিতে জড়িয়ে পড়েন। এর মধ্যে ঠিকমতো পণ্য না পাওয়া ও ডিলাদের প্রতি স্বজনপ্রীতিরও অভিযোগ করেন কেউ কেউ।

টিসিবির পণ্য বিতরণের পুরো বিষয়টি দেখভাল করেন গাজীপুরের জেলা প্রশাসক মো. আনিসুর রহমান। সার্বিক বিষয়ে জানতে কথা হলে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘মূলত এটা সমাজের দরিদ্র শ্রেণির মানুষের জন্য। তাঁদের উপকারের কথা ভেবেই সরকার ভর্তুকি মূল্যে এ কার্যক্রম শুরু করে। এখন দ্রব্যমূল্য বাড়ায় এসব পণ্যের চাহিদাও বেড়েছে। তবে এর মধ্যে যদি কোনো প্রকার অনিয়ম বা স্বজনপ্রীতির অভিযোগ পাওয়া যায়, তবে অবশ্যই তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’