এইচএসসি পরীক্ষার পর ফলাফল নিয়ে উৎকণ্ঠায় ছিলেন সানজিদা আফরোজ (অর্পা)। কাঙ্ক্ষিত ফলাফল পেয়ে এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছেন তিনি। সানজিদা বলেন, ‘পড়াশোনার ব্যস্ততায় বন্ধুদের সঙ্গে ঠিকমতো দেখা বা কথাও হচ্ছিল না। একটা ভালো গেট-টুগেদারের সুযোগ পেলাম। শুধু আড্ডা নয়, সবার প্রস্তুতি ও ভবিষ্যৎ ভাবনা নিয়েও আলোচনা হচ্ছে। বেশ ভালো লাগছে।’
শনিবার খুলনায় প্রেসিডেন্সি ইউনিভার্সিটি-প্রথম আলো জিপিএ-৫ কৃতী শিক্ষার্থী উৎসব-২০২৫-এ যোগ দিয়ে এভাবেই নিজের অনুভূতি ব্যক্ত করেন খুলনার মজিদ মেমোরিয়াল সিটি কলেজ থেকে জিপিএ-৫ পাওয়া কৃতী শিক্ষার্থী সানজিদা আফরোজ। খুলনা জিলা স্কুল মাঠে আয়োজিত এ উৎসবে নিবন্ধন করেন প্রায় দুই হাজার শিক্ষার্থী।
‘স্বপ্ন থেকে সাফল্যের পথে, একসাথে’ প্রতিপাদ্যে সারা দেশের এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থীদের নিয়ে এবারই প্রথম এমন উৎসবের আয়োজন করেছে প্রথম আলো। চট্টগ্রাম, রংপুর ও ঢাকার পর আজ খুলনায় হলো চতুর্থ আয়োজন। অন্য চারটি বিভাগীয় শহরেও সংবর্ধনা দেওয়া হবে। উৎসবের পৃষ্ঠপোষক প্রেসিডেন্সি ইউনিভার্সিটি।
সকাল থেকেই কৃতী শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের পদচারণে মুখর হয়ে ওঠে খুলনা জিলা স্কুল মাঠ। নির্ধারিত বুথ থেকে ক্রেস্ট, স্ন্যাকস ও ডিজিটাল সার্টিফিকেট সংগ্রহ করে বন্ধুদের সঙ্গে আনন্দে মেতে ওঠেন শিক্ষার্থীরা। জীবনের লক্ষ্য লেখার বোর্ডে অনেকে লিখছিলেন নিজের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা। এসব লেখায় মেডিকেল কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি, বৃত্তি নিয়ে বিদেশ গমন কিংবা ভালো মানুষ হওয়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন তাঁরা।
উৎসবে অংশ নিতে মায়ের সঙ্গে সকাল ৯টার আগেই খুলনা জিলা স্কুলে এসে পৌঁছান মোসাম্মৎ ফারিয়া আক্তার। ঝিনাইদহের মহেশপুর থানার মদনপুর গ্রামের এই শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তির জন্য যশোরে থেকে কোচিং করছেন। অনুষ্ঠানস্থলে পৌঁছে সহপাঠীদের সঙ্গে ছবি তুলছিলেন তিনি। ফারিয়ার মা রেবেকা খাতুন বলেন, ‘ভোর সাড়ে পাঁচটায় যশোর থেকে বাসে উঠেছি। এসএসসিতে ভালো ফল করেছে। এখন ও পছন্দের বিষয় নিয়ে ভালো বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পেলে কষ্ট সার্থক হবে।’ তিনি বলেন, মেয়েকে উৎসাহিত ও অনুপ্রাণিত করতে এখানে নিয়ে এসেছেন। অনেক গুণী মানুষ আসবেন, কথা বলবেন। নিশ্চয়ই ভবিষ্যতের দিকনির্দেশনা পাবে।
নড়াইলের সরকারি ভিক্টোরিয়া কলেজ থেকে জিপিএ-৫ পাওয়া সঞ্চিতা চক্রবর্তী ও জেসিয়া ইসলাম বলেন, পড়াশোনার চাপের মধ্যে আজকের দিনটা একটু আনন্দের। এমন আয়োজনের জন্য প্রথম আলোকে ধন্যবাদ। অনেক দিন পর বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডার সুযোগ হলো।
সকাল সাড়ে ১০টায় মঞ্চে ওঠেন প্রথম আলোর যুব কার্যক্রমের সমন্বয়ক মুনির হাসান। এরপর জাতীয় সংগীতের মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠান শুরু হয়। স্বাগত বক্তব্য দেন প্রথম আলোর খুলনা প্রতিনিধি উত্তম মণ্ডল। এরপর খুলনা জিলা স্কুলের প্রধান শিক্ষক মোহাম্মদ ফারুকুল ইসলাম শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে অনুপ্রেরণামূলক কথা বলেন।
পর্যায়ক্রমে প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক আনোয়ারুল কবির, সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের প্রধান মো. মোস্তাফিজুর রহমান, ইংরেজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মো. হাবিবুল্লাহ ও প্রভাষক তাসমানিয়া নওরিন বিশ্ববিদ্যালয়ের সুযোগ-সুবিধা ও বিভাগীয় সম্ভাবনার কথা জানান।
এরপর মঞ্চে আসেন কবি ও ঔপন্যাসিক সাদাত হোসাইন। তিনি বলেন, ‘স্বপ্ন থাকতে হবে। স্বপ্ন বাস্তবায়নে বাধা আসবে। কিন্তু তা অতিক্রম করা যায়। পৃথিবীর সব মানুষ কোনো না কোনোভাবে জিনিয়াস। জ্ঞানের চেয়ে কল্পনা শক্তিশালী; কল্পনা বাড়াতে বই পড়তে হবে—কাগজের বই ও জীবনের বই দুটোই।’ ভালো ফলাফলের পাশাপাশি অনুভূতিশীল মানুষ হিসেবে বেড়ে ওঠার পরামর্শ দেন তিনি।
‘আয়রনম্যান’ মোহাম্মদ শামসুজ্জামান আরাফাত বাংলা চ্যানেলে সাঁতার, টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া পর্যন্ত দৌড়ানোর অভিজ্ঞতা ভাগাভাগি করে নিয়ে বলেন, ‘শরীরকে কাজ করাতে হবে, নাড়াতে হবে। সেটা দৌড়, ফুটবল বা যেকোনো শারীরিক কার্যক্রমই হতে পারে। প্রতিদিন মাত্র ৩০ মিনিট নিজের সঙ্গে থাকা, চিন্তা করা—জীবনের পথকে পরিষ্কার করে দেয়। নিজের সঙ্গে একটু আলাপ করা খুব জরুরি। আমি কে, কী চাই—এটা জানলেই আর কোনো কিছুর জন্য কাউকে জিজ্ঞেস করতে হয় না।’
সৃজনশীলতা ও উদ্যোগ নিয়ে কথা বলেন ‘যুক্ত ডিজিটালের’ প্রতিষ্ঠাতা আবু আশরাফ মাসনুন ও কুয়েটের অধ্যাপক মো. হেলাল-আন-নাহিয়ান। মাঝেমধ্যে শিক্ষার্থীদের নিয়ে মজার গেম পরিচালনা করেন সঞ্চালক মুনির হাসান—বার্তা ছিল, শুধু প্রতিযোগিতা নয়, সহযোগী মনোভাবও জরুরি। প্রথম পর্বের মাঝামাঝি সময়ে মঞ্চে আসেন গীতিকার কবির বকুল ও অভিনেত্রী কেয়া পায়েল। কেয়া পায়েল শিক্ষার্থীদের প্রশ্নের উত্তর দেন ও অনুপ্রেরণার গল্প শোনান।
প্রথম পর্ব শেষে ভর্তি পরীক্ষার প্রস্তুতি নিয়ে কথা বলেন খুলনা মেডিকেল কলেজের জ্যোতিপ্রকাশ মণ্ডল, বুয়েটের অনিরুদ্ধ রায় ও খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের উৎপল কুমার মণ্ডল। নতুন যুগের দক্ষতা—কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও রোবোটিকস বিষয়ে আলোচনা করেন প্রথম আলোর চিফ ডিজিটাল বিজনেস অফিসার এ বি এম জাবেদ সুলতান পিয়াস।
দ্বিতীয় পর্বে কবির বকুলের সঙ্গে মঞ্চে আসেন পারশা মাহজাবীন। তিনি শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে গান শোনেন এবং নিজেও দুটি গান পরিবেশন করেন। এরপর মঞ্চ মাতান রকস্টার মিথুন রায়। এরপর মঞ্চে ওঠে জনপ্রিয় ব্যান্ডদল ‘অড সিগনেচার’। তাঁদের সঙ্গে আনন্দে মেতে ওঠেন শিক্ষার্থীরা।
শিক্ষার্থীদের জন্য অনুষ্ঠানস্থলে বসানো হয় ফটো বুথ, ৩৬০ ডিগ্রি সেলফি বুথ। প্রথম আলোর স্টলে সাধারণ জ্ঞান নিয়ে ছিল কুইজ। দক্ষতা নিয়ে ছিল প্রতীকী ভোট। কুইজে অংশ নিয়ে অনেকে পুরস্কার জেতেন। অনুষ্ঠানস্থলে প্রাথমিক চিকিৎসার দায়িত্ব পালন করে রেড ক্রিসেন্ট খুলনা সিটি ইউনিট। এ ছাড়া ওটিটি প্ল্যাটফর্ম চরকি ও প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টলে ছিল চোখে পড়ার মতো ভিড়।