লেপ-তোশক বানিয়ে জীবন চলে ইশাকের
কনকনে ঠান্ডা। ঘন কুয়াশায় দুই দিন ধরে দেখা নেই সূর্যের। সেই সঙ্গে বইছে শীতল বাতাস। শীতে জবুথবু অবস্থা সবার। একটু উষ্ণতার জন্য বিদ্যুতের তারে গা ঘেঁষাঘেঁষি করে বসে আছে পাখির দল। আর হাতে, পায়ে, মাথায় মোটা কাপড় পরে শীত থেকে দূরে থাকার চেষ্টায় আছে মানুষজন। এমন অবস্থার মধ্যে রোববার সকাল ৯টার দিকে তোশক সেলাইয়ের কাজ করছিলেন মো. ইশাক।
খুলনা নগরের শেরে বাংলা সড়কের সোয়াট চিলড্রেন স্কুলের সামনে ইশাকের দোকান। পরনে হাফ প্যান্ট ও পাতলা হাফ গেঞ্জি। কান দুটি ঢাকা রয়েছে একটি ব্যান্ড দিয়ে। পাশে বসেই কথা হয় ইশাকের সঙ্গে। তিনি লেপ-তোশক তৈরির কারিগর।
ইশাকের বয়স ১৯ বছর। তিন বছর বয়সেই মা মারা যান। এরপর ঠাঁই হয় দাদা-দাদির কাছে। বাবা আরেকটি বিয়ে করেছেন। দাদা-দাদির কাছে থাকলেও ইশাককে মানুষ করেছেন তাঁর ছোট চাচা মো. আসলাম। নগরের বসুপাড়া এলাকায় ওই চাচার একটি লেপ-তোশকের দোকান আছে। সাত বছর বয়স থেকেই ওই দোকানে কাজ শুরু করেন ইশাক। পাশাপাশি পড়াশোনাও চালিয়ে যান। সপ্তম শ্রেণি পর্যন্ত পড়তে পেরেছেন। গত ডিসেম্বরে একজনের সঙ্গে ভাগাভাগি করে নতুন ওই দোকান দিয়েছেন। এত দিন চাচার দোকানেই কাজ করতেন।
ইশাক বলেন, ‘আর্থিক অনটন, দেখাশোনার কেউ নেই—এ কারণে পড়াশোনাটা আর চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি। তবে চাচার দোকান থেকে লেপ-তোশক বানানোর কাজটি ভালোভাবে শিখে ফেলেছি। এখন সেটিই আমার আয়ের প্রধান উৎস।’
কথার মধ্যে তোশক সেলাইয়ের কাজও চলতে থাকে সমান তালে। তবে ঠান্ডায় হাত সেভাবে চলতে চাইছে না। সুই ধরতেও কেমন যেন আড়ষ্টতা কাজ করছে। সে কথাই জানালেন ইশাক। তিনি বলেন, ‘শীতে হাত ঠান্ডা হয়ে গেছে। তাই ভালো করে সুই ও সুতা ধরতে পারছি না। কাজেও দেরি হচ্ছে।’ গায়ে শীতের মোটা কাপড় জড়ালে ভালো করে বসে কাজ করা যায় না, এ কারণে প্রচণ্ড শীতের মধ্যেও তিনি শুধু হাফ প্যান্ট ও গেঞ্জি পরে কাজ করছেন বলে জানান।
একটা মাঝারি আকারের তোশক তৈরি করতে ইশাকের সময় লাগে প্রায় আধা ঘণ্টা। আর যদি সেটি ভালোভাবে তৈরি করা হয়, তাহলে ৪৫ মিনিট লেগে যায়। এ ধরনের একটি তোশক তৈরি করে ইশাক মজুরি পান ১৫০ টাকা। আর লেপ তৈরির মজুরি পান ২০০ টাকা। লেপ তৈরি করতে তাঁর সময় লাগে আড়াই ঘণ্টার মতো। মাত্র ১০ মিনিটের মধ্যে তৈরি করতে পারেন বালিশ।
দুই বছর আগে বিয়ে করেছেন ইশাক। তাঁর ঘরে ছোট একটি মেয়ে আছে। বিয়ের পর আলাদা বাসা ভাড়া নিতে হয়েছে। এখন নিজের সংসার নিজেকেই চালাতে হচ্ছে। লেপ-তোশক তৈরির আয় দিয়েই তা করেন।
ইশাক বলেন, মূলত সারা বছর তোশক ও বালিশের চাহিদা থাকলেও তা অনেক কম। শীতের আভাস পড়তেই শুরু হয় তাঁদের ব্যস্ততা। তবে সেটি মাত্র তিন মাসের। এরপর আবার সেই ঝিমিয়ে ঝিমিয়ে কাজ। কোনো কোনো দিন কাজই হয় না। আর কাজ না হলে মজুরিও পাওয়া যায় না। তখন শুরু হয় আর্থিক অনটন। জিনিসপত্রের মূল্যের ঊর্ধ্বগতিও প্রতিনিয়ত বিদ্ধ করছে ইশাককে। চাইলেও মেয়ের জন্য ভালো জামাকাপড় বা খেলনা কিনতে পারেন না। ভালো খাবারও জোটে না। তবে স্বল্প আয়ে সবকিছু মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছেন।
নতুন স্বপ্ন নিয়ে দোকান করেছেন ইশাক। বললেন, ‘আর কোনো কাজ শিখিনি। এ কারণে যে কাজ শিখেছি, তা দিয়েই কীভাবে ভালো থাকা যায়, সেই চেষ্টা করছি।’