বাগেরহাটে বাড়িঘরে হামলা-ভাঙচুরের পর উল্টো বিএনপির নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা

বাড়িঘরে হামলা–ভাঙচুরের ক্ষত চিহ্ন
ছবি: প্রথম আলো

বাগেরহাটের চিতলমারীতে আওয়ামী লীগের সভায় ককটেল হামলার অভিযোগে বিএনপি ও জাতীয় পার্টির ৪২ নেতা–কর্মীর বিরুদ্ধে মামলা করেছেন আওয়ামী লীগের স্থানীয় এক নেতা। মামলায় অজ্ঞাতনামা ৪০–৫০ জনকে আসামি করা হয়েছে। এজাহার অনুযায়ী গত ১০ অক্টোবর রাতে চিতলমারীর কলাতলা ইউনিয়নের কাননচক বাজারে এ ঘটনা ঘটে।

তবে মামলার সাক্ষী ও চারজন প্রত্যক্ষদর্শী বলেন, বিএনপির স্থানীয় কয়েকজন কর্মী কয়েক দিন আগে খুলনার একটি সমাবেশে গিয়েছিলেন। ওই কর্মসূচিতে যাওয়া নিয়ে আওয়ামী লীগের লোকজন তাঁদের মারধর করেন। পরে খালের অন্য পাড়ে কারা যেন ককটেল ফাটায়।

চিতলমারী থানায় বিস্ফোরক দ্রব্য আইনে করা মামলাটি হয় ১১ অক্টোবর। আসামিদের মধ্যে দুজন জাতীয় পার্টির নেতা ছাড়া সবাই স্থানীয় বিএনপি ও এর সহযোগী সংগঠনের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। এজাহারে ঘটনাস্থল থেকে চারটি অবিস্ফোরিত ককটেল ও বিস্ফোরিত ককটেলের অংশবিশেষ এবং কয়েকটি বাঁশের লাঠি জব্দের কথা উল্লেখ করা হয়েছে।

মামলার বাদী কলাতলা ইউনিয়নের ৬ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি আজিজুল ইসলাম খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা যুবলীগ, ছাত্রলীগের পোলাপাইনদের নিয়ে কথা বলার সময় বিএনপি-জামায়াতের লোকজন আইসা হঠাৎ কইরা আক্রমণ করছে, বোম মারছে। সম্ভবত ছয়টা ককটেল, তিনটা ফুটছে, তিনটা ফুটে নাই। লাঠিঠেঙ্গা নিয়া আসছে। ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সেক্রেটারির হাত ভেঙে গেছে। পরিকল্পিতভাবে জিনিসটা হইছে।’

ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ও স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কাননচক বাজারে বিএনপির দু–তিনজন নেতা–কর্মীকে মারধরের পর আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনের শতাধিক নেতা–কর্মী বিএনপির নেতা–কর্মীদের বাড়িতে গিয়ে হামলা ও ভাঙচুর করেন। পরে সেখান থেকে মিছিলসহকারে আবার বাজারে চলে আসেন। এরপর কে বা কারা ককটেল ফাটায়।

মামলার ৭ নম্বর আসামি করা হয়েছে কাননচক গ্রামের তানভীর শেখকে (২৮)। তাঁর বাবা মো. ওহিদ শেখ (৫৫) মামলার ১ নম্বর আসামি। ১০ অক্টোবর সন্ধ্যায় তাঁদের বাড়িতে হামলা হয়। এর আগে কাননচক বাজারে তানভীর ও তাঁর চাচাকে মারধর করেন আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের নেতা–কর্মীরা।

তানভীর প্রথম আলোকে বলেন, খুলনায় বিএনপির সমাবেশে যাওয়ায় আওয়ামী লীগের লোকজন আগে থেকেই হুমকি দিচ্ছিলেন। এ ছাড়া সম্প্রতি ফেসবুকে একটি ছবি দেওয়ায় বারবার ভয়ভীতি দেখাচ্ছিলেন। এ ঘটনায় তিনি ছাত্রলীগের নেতা মাহবুরের এক মুরব্বির কাছে বিচার দিয়েছিলেন। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে ১০ অক্টোবর সন্ধ্যায় বাজারে আওয়ামী লীগের লোকজন তাঁকে ও তাঁর চাচাকে মারধর করেন। পরে বাজারে আটকে রেখে তাঁর বাবার সমিতি কার্যালয় ভাঙচুর করেন। অবস্থা খারাপ দেখে মুরব্বিরা তাঁকে পালাতে সাহায্য করেন। না হলে হয়তো তিনি সেদিন মারা যেতেন।

ছাত্রদলের সাবেক নেতা তানভীর কলাতলা ইউনিয়ন স্বেচ্ছাসেবক দলের আহ্বায়ক। তাঁর বাবা ওহিদ বিএনপির সমর্থক। তিনি বলেন, ‘আমাদের কী অপরাধ জানি না। বাজারে আমার একটা ছোট সমিতি আছে, এ নিয়ে রাগ কি না, তা–ও জানি না। ছেলেরে মারতেছে শুনে ঠেকাতে গিয়ে আমিও মাইর খাইছি। সবকিছু ভেঙেচুরে শেষ করে দিছে। হামলা–ভাঙচুরের পর শুনি, মামলা দিছে। তারপর ঢাকায় গিয়ে জামিন নিছি। ভয়ে এখনো বাড়িতে যেতে পারছি না।’

২৫ অক্টোবর সরেজমিন দেখা গেছে, ওহিদ শেখসহ পাশাপাশি তিনটি বাড়িতে হামলার চিহ্ন। বাড়ির দরজা-জানালা, টিনের বেড়া—সবখানে দা–কুড়ালের কোপের দাগ। লাঠিসোঁটার আঘাতে ভেঙেছে কাঠের জানালাগুলো। ঘরের মধ্যেও হামলার চিহ্ন স্পষ্ট। খাট, রেফ্রিজারেটর, শোকেস, ফ্যান, থালাবাসন—সবই ভাঙচুর করা হয়েছে। কয়েকটি ঘর কিছুটা মেরামত করা হয়েছে। ঘরের সামনে বৃষ্টির পানি ধরে রাখার বড় একটি ট্যাংকও কুপিয়ে নষ্ট করে দেওয়া হয়েছে।

ওহিদ শেখের স্ত্রী জোবেদা বেগম বলেন, ‘সন্ধ্যার পর টের পাই, দুয়োর দিয়ে মানুষ আসতেছে। ভয়ে ঘরে খিল দেই। শত শত মানুষ; দা, লাঠিসোঁটা নিয়ে হামলা শুরু করে। অনেক অনুনয়–বিনয় করছি, তা–ও দরজা ভেঙে ঘরে ঢুকে যায়। সবকিছু ভেঙে তছনছ করছে। ঘরে থাকা টাকা, গয়নাও নিয়ে গেছে। তখন বাড়িতে আমি, আমার ছেলের বউ আর ছোট্ট একটা বাচ্চা। ভয়ে বাচ্চাটা কাঁদছিল, তা–ও কেউ কোনো কথা শোনেনি। এখনো হুমকি–ধমকি চলছে। নাকি সব আগুন দিয়ে দেবে।’

মামলার ৮ নম্বর আসামি ফরিদ শেখের এক আত্মীয় বলেন, তাঁর ভাই–ভাতিজাকে মারধরের পর তাঁরা কোনোমতো পালিয়ে চিকিৎসকের কাছে যান। বাজারের ঘর ভাঙচুর করে শত শত লোক নিয়ে বাড়িতে আসেন। তিনি তখন রাস্তায়। অবস্থা দেখে ভয়ে বাগানে পালিয়ে থাকেন। তাঁরা একে একে তাঁদের তিনটি ঘরে ভাঙচুর চালান। যাওয়ার পথে রাস্তায় তাঁর মামা ও মামলার ৪০ নম্বর আসামির করাতকল, চা ও মুদিদোকান ভাঙচুর করেন। তিনি বলেন, ‘তখন আমরা বুঝলাম, পাইলে আমাগেও মারবে। ভয়ে পাশের হিন্দুবাড়িতে আশ্রয় নিই। তারা চলে গেলে বাড়ি এসে দেখি ওই অবস্থা। আমার আব্বা বাড়িতে একা ছিল। তাগো আঘাতে সে অজ্ঞান হয়ে গেছিল। পরে আমরা এসে পানিচুনি দিয়ে জ্ঞান ফেরাই।’

কাননচক গ্রামের পাশের শৈলদাহ ও হিজলা গ্রামের দুই আসামি বলেন, ‘কী বলব, আমরা কিছুই জানি না। শুধু শুধু আসামি হইছি। কথা কতিও ভয় করে। ওগর বাড়িঘর ভাঙছে, শোনার পরও যাইনি। গেলি না হয় আড্ডু কিছু হবেনে। এমনিতেই রাইত হলি কেউ বাড়িতে থাহি না ভয়ে। আগানে-বাগানে, মাঠে থাকতে হয়।’

মামলার ২৪ নম্বর আসামি মো. খিজির শেখ (৫০) চিতলমারী উপজেলা জাতীয় পার্টির অর্থ সম্পাদক। তিনি বলেন, ‘কিছুই জানি না, কী হইছে। আসামি হইছি কেন, তা–ও জানি না। সেদিন আমি সেখানে ছিলামও না। জাতীয় পার্টি তো আওয়ামী লীগের শরিক। আমাগো কেন মামলা দিল জানতে চাইছিলাম, বাদীর কাছে। বলে সে–ও জানে না।’

মামলায় জাতীয় পার্টি নেতাদের আসামি করার বিষয়ে আজিজুল বলেন, ‘জাতীয় পার্টি তো আওয়ামী লীগের শরিক। তবে তারা স্থানীয়ভাবে বিএনপির সমর্থন করে।’ বিএনপির নেতা–কর্মীদের বাড়িঘর ভাঙচুরের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘পাবলিক ক্ষিপ্ত হইয়া একটুই করছিল আরকি। আর নিজেরাই নিজেদের ঘর–দরজা বাড়াইয়াই করছে।’

বিএনপির নেতা–কর্মীদের মারধর, বাড়িঘর ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে হামলা-ভাঙচুর করে উল্টো নাশকতার মিথ্যা মামলা দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন চিতলমারী উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক টুলু বিশ্বাস। তিনি বলেন, বিএনপির নেতা–কর্মীরা বাড়িতে থাকতে পারছেন না। বর্বর যুগের মতো তাঁদের ওপর হামলা হচ্ছে। পরে আবার তাঁদের বিরুদ্ধে মিথ্যা ও ‘গায়েবি মামলা’ করছে। কার কাছে তাঁরা বিচার চাইবেন?

এ ব্যাপারে কথা বলতে চিতলমারী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এ এইচ এম কামরুজ্জামান খানের মুঠোফোনে একাধিকবার কল করা হলেও তিনি সাড়া দেননি।

বিএনপি ও জামায়াতের নেতারা বলছেন, গত এক মাসে জেলায় এ ধরনের ১০টি নতুন মামলায় জ্ঞাত-অজ্ঞাত আসামি করা হয়েছে পাঁচ শতাধিক নেতা–কর্মীকে। পুরোনো মামলা তো আছেই।