নওগাঁর ফুটবল সংগঠকের সাক্ষাৎকার

পৃষ্ঠপোষকতা কমেছে, এটা বাড়লে আরও নারী ফুটবলার উঠে আসবে

আলমগীর কবির
ছবি: সংগৃহীত

সম্প্রতি নওগাঁয় শুরু হয়েছে আন্তজেলা নারী ফুটবল টুর্নামেন্ট। নওগাঁসহ আটটি জেলার নারী ফুটবল দল এই টুর্নামেন্টে অংশগ্রহণ করছে। এই খেলাকে ঘিরে স্থানীয় মানুষের মধ্যে ব্যাপক উৎসাহ তৈরি হয়েছে। নওগাঁ জেলা স্টেডিয়ামে চলা এই টুর্নামেন্টে নারী ফুটবলারদের খেলা দেখতে কানায় কানায় ভরে উঠছে গ্যালারি।

দীর্ঘদিন ধরে নওগাঁর নজিপুর, বদলগাছী, মহাদেবপুর ও ধামইরহাট উপজেলায় চারটি নারী ফুটবল একাডেমি নারী ফুটবলার তৈরিতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখে চলেছে। এর মধ্যে ধামইরহাট গ্রিন ভয়েস নারী ফুটবল একাডেমির অনেক খেলোয়াড় জেলা, বিভাগীয় পর্যায় ও জাতীয়ভাবে বিভিন্ন বয়সভিত্তিক দলে খেলছেন। নারীদের ফুটবল খেলার নানা আয়োজন নিয়ে প্রথম আলো কথা বলেছে নারী ফুটবলের সংগঠক আলমগীর কবিরের সঙ্গে।

প্রশ্ন:

নওগাঁয় প্রথমবারের মতো আন্তজেলা পর্যায়ে নারী ফুটবল আয়োজন সম্পর্কে আপনার অভিব্যক্তি কী

আলমগীর কবির: ফুটবল সারা বিশ্বে সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলা। বাংলাদেশে অনেক ঐতিহ্য আছে ফুটবলের। একসময় প্রত্যন্ত গ্রামপর্যায়ে ফুটবল খেলা দেখতে হাজারো দর্শকের সমাগম হতো। দুই-এক দশক ধরে ফুটবলে একটা মন্দাভাব দেখছি। বিশেষ করে ছেলেদের ফুটবলে। সম্প্রতি যদি কোনো অর্জন আসে, সেটি কিন্তু নারী ফুটবল দলই এনেছে। প্রত্যন্ত এলাকা থেকে নারী ফুটবলাররা উঠে আসায় এই সফলতা এসেছে। ফুটবল আমাদের জাতীয় ঐতিহ্য। এই ঐতিহ্যকে ফিরিয়ে আনতে প্রত্যন্ত এলাকা থেকে ফুটবলার তৈরি করতে হবে। কিন্তু আমরা দেখছি, পৃষ্ঠপোষকতা এখন অনেক কমে গেছে। আগে ঘন ঘন ফুটবল প্রতিযোগিতা ও টুর্নামেন্ট হতো। পৃষ্ঠপোষতার অভাবে এখন সেটা তেমনটা আর হচ্ছে না। আমি মনে করি, ফুটবলকে আগের ঐতিহ্যে ফিরিয়ে আনতে হলে ছোট আকারে হলেও অনেক বেশি টুর্নামেন্টের আয়োজন করতে হবে। সেই জায়গা থেকে নওগাঁয় বকুল বালিকা নামের একটি নারী সংগঠন নারী ফুটবল টুর্নামেন্টের যে আয়োজন করেছে, এটা প্রশংসনীয় উদ্যোগ।

প্রশ্ন:

নারী ফুটবলারদের প্রশিক্ষণ দিয়ে তৈরির ভাবনাটা কী করে এল?

আলমগীর কবির: গ্রিন ভয়েস হচ্ছে একটা স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। সংগঠনটি সারা দেশে ছড়িয়ে আছে। আমি হচ্ছি, গ্রিন ভয়েসের কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক। গ্রিন ভয়েস কিশোর বাংলা ফুটবল একাডেমি নামে বাফুফের রেজিস্টার্ড হওয়া একটা একাডেমি আছে। এই একাডেমির মূল প্রশিক্ষণকেন্দ্র কুড়িগ্রামে। ওখানে প্রত্যন্ত গ্রামের স্কুলের ১০ বছর থেকে শুরু করে ১৮ বছর বয়সী ছেলেদের ফুটবল প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। কুড়িগ্রামের একজন আমাদের জায়গা দিয়েছেন। ওখানে ক্যাম্প করে ছেলেদের ফুটবল শেখানো হচ্ছে। গত বছর আমাদের একাডেমির খেলোয়াড়দের একটি দল অনুর্ধ্ব-১৫ বাফুফে পাইওনিয়ার ফুটবল টুর্নামেন্টে অংশ নেয়। সেই টুর্নামেন্টে আমাদের দল রানার্সআপ হয়। ওই একাডেমির সফলতা দেখার পর অনেকে আমাকে বলেন যে আপনি ছেলেদের ফুটবল শেখাচ্ছেন, নারী ফুটবলার তৈরির জন্য একাডেমি করছেন না কেন? তখন আমি চিন্তা করলাম, যেহেতু কুড়িগ্রামে আমাদের ছেলেদের ফুটবল একাডেমি রয়েছে, আমাদের এলাকায় একটু খোঁজ নিই। আমার গ্রামের বাড়ি নওগাঁর ধামইরহাট উপজেলায়। স্থানীয় সাংস্কৃতিক সংগঠক মোস্তফা মেহমুদ রাসেল আমাকে খোঁজ দেন যে নওগাঁর বদলগাছী, নজিপুর, মহাদেবপুর ও ধামইরহাটে নারী ফুটবল দল আছে। কিন্তু সেই দলগুলো পৃষ্ঠপোষতার অভাবে ভালো কিছু করতে পারছে না। ধীরে ধীরে দলগুলো ভেঙে যাচ্ছে।

তখন আমি এলাকায় গিয়ে ওই দলগুলোর প্রশিক্ষক ও খেলোয়াড়—সবার সঙ্গে সাক্ষাৎ করি। তাঁরা জানান, মোহাম্মদ আলী নামের এক ব্যক্তি আছেন ধামইরহাটের ফুটবল প্রশিক্ষক। তিনি স্কুলের মেয়েদের ফুটবল শেখাচ্ছেন। তাঁর সঙ্গে কথা বলার পর আমি তাঁকে বলি, আপনার মেয়েদের নিয়ে আসেন, আমি তাঁদের সঙ্গে কথা বলতে চাই। মেয়েরা বলে, ‘আমাদের বুট নেই, জার্সি নেই। এমনকি বলটাও ঠিকমতো পাই না।’ তখন আমি তাদের বলি, তোমাদের সব চাহিদা পূরণ করা হবে। তোমাদের শুধু ভালো করে ফুটবল শিখতে হবে। প্রথমে ১৬ জন মেয়ে দিয়ে গ্রিন ভয়েস নারী ফুটবল একাডেমির কার্যক্রম শুরু হয়। মেয়েদের জার্সি, বুট, বল, নেটসহ সব সরঞ্জাম দেওয়া হয়। শুরু থেকে এখন পর্যন্ত মেয়েদের বাড়ি থেকে ক্যাম্পে যাওয়া-আসা ও বিকেলের নাস্তার সব খরচ গ্রিন ভয়েস থেকে দেওয়া হচ্ছে। এখন আমাদের একাডেমিতে ৩২ জন নারী ফুটবলার প্রশিক্ষণ নিচ্ছে।

প্রশ্ন:

আপনার একাডেমির খেলোয়াড়দের নিয়ে আপনার প্রত্যাশা কী

আলমগীর কবির: প্রতিষ্ঠার তিন বছরের মধ্যেই আমি মনে করি, আমরা অনেকটাই সফল হয়েছি। আমাদের তিনজন খেলোয়াড় বর্তমানে রাজশাহী বিভাগীয় দলে খেলছে। এ ছাড়া জেলা ও বয়সভিত্তিক দলেও আমাদের মেয়েরা অংশ নিচ্ছে। যেহেতু নারী ফুটবল টিম জাতীয়ভাবে ভালো করছে, নারী ফুটবলাররা অনেক প্রশংসা কুড়াচ্ছে। আমাদের প্রত্যাশা, আমাদের একাডেমি থেকে নারী ফুটবলাররা যাতে জাতীয় পর্যায়ে খেলতে পারে, দেশের জন্য সুনাম বয়ে আনতে পারে। সেই লক্ষ্যে এই মেয়েদের আমরা অনুশীলনের মধ্যে রাখছি। যদিও আমাদের আর্থিক ও অন্যান্য সামর্থ্য খুব বেশি নেই। তারপরও স্বপ্ন পূরণে আমরা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।

প্রশ্ন:

দেশে নারী ফুটবলারদের এগিয়ে নিতে কী কী পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে বলে আপনি মনে করেন?

আলমগীর কবির: আমাদের দেশে মফস্‌সল এলাকা এবং প্রত্যন্ত গ্রামের অনেক নারী ফুটবল খেলায় অংশ নিতে চায়। কিন্তু অদম্য ইচ্ছা থাকলেও পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে তারা ফুটবলসহ যেকোনো ধরনের খেলাধুলায় খুব বেশি দূর এগোতে পারে না। স্কুলপড়ুয়া কিশোরীরা বড়জোর মাধ্যমিক পর্যায় পর্যন্ত খেলাধুলার চর্চা চালিয়ে যেতে পারে। এরপর আর এগোতে পারে না। তাদের অদম্য ইচ্ছা পূরণের জন্য সমাজের বিত্তবান ও সচেতন মানুষদের পৃষ্ঠপোষকতা করা উচিত। পৃষ্ঠপোষকতা পেলে প্রত্যন্ত এলাকা থেকে আরও ভালো ভালো নারী ফুটবলার উঠে আসবে।

প্রশ্ন:

মফস্‌সল কিংবা প্রত্যন্ত এলাকা থেকে নারী ফুটবলারদের এগিয়ে নিতে প্রধান বাধা কী

আলমগীর কবির: পারিবারিক ও সামাজিকভাবে আমরা তেমন কোনো সমস্যা লক্ষ করছি না। প্রধান সমস্যা হচ্ছে, পৃষ্ঠপোষকতার অভাব। এ ছাড়া প্রত্যন্ত এলাকায় ভালো প্রশিক্ষক পাওয়া যায় না। ভালো প্রশিক্ষক না পাওয়া একটা বড় সমস্যা। জাতীয় পর্যায় থেকে ভালো প্রশিক্ষক এনে এক মাস কিংবা দুই মাস ধরে একাডেমির মেয়েদের ক্যাম্প করে প্রশিক্ষণ করাতে পারলে ভালো হতো। কিন্তু আর্থিক সংকটের কারণে সেটা করা সম্ভব হয় না।

প্রশ্ন:

নারী ফুটবলারদের নিয়ে আপনার প্রত্যাশা কী

আলমগীর কবির: আমাদের নারী ফুটবলাররা সাফ চ্যাম্পিয়নশিপে জয় পেয়েছে। এখন আমাদের প্রত্যাশা আরও বড়। আমার প্রত্যাশা হলো, একদিন আমাদের নারী ফুটবলাররা ফুটবলের সবচেয়ে বড় আসর বিশ্বকাপ জয় করবে।