বগুড়ার ফুটপাত থেকে অভিজাত রেস্তোরাঁ—সবখানেই বাহারি ইফতারির পসরা

রমজানের প্রথম দিনে ইফতারসামগ্রী কিনতে দোকানে এসেছেন এক ব্যক্তি। রোববার বিকেলে বগুড়া শহরের সেউজগাড়ি এলাকায়ছবি: সোয়েল রানা

কাবাব, কোফতা, রোস্ট, হালুয়া, গ্রিল–তন্দুরি থেকে বুট, বুন্দিয়া, বেগুনি, পেঁয়াজু, জিলাপি। হরেক স্বাদের বিরিয়ানি, মোরগ পোলাও থেকে শুরু করে বাহারি কাচ্চি। লাচ্ছি, ফালুদা থেকে শুরু করে টক দইয়ের ঘোল। কী নেই বগুড়ার বাহারি ইফতারির বাজারে!

রোববার রমজানের প্রথম দিনেই বগুড়া শহরের ফুটপাত থেকে শুরু করে অভিজাত রেস্তোরাঁ—সবখানেই ছিল বাহারি ইফতারির পসরা। শহরের কাঁঠালতলা, বড়মসজিদ লেনের সামনে, ফতেহ আলী মাজারের সামনে ইফতারির পসরা সাজিয়ে বসেন দোকানিরা। এখানাকার মূল আয়োজন ছিল জিলাপি, ছোলা, পেঁয়াজু, বেগুনিসহ নানা সামগ্রী। অভিজাত ক্রেতাদের ইফতারির বাজার হিসেবে পরিচিত জলেশ্বরীতলার ইফতারির বাজারে মূল আকর্ষণ ছিল হালিম, মুরগির রোস্ট, কাবাব ও কাচ্চি বিরিয়ানি। সুস্বাদু এসব ইফতারির স্বাদ নিতে ভিড় করেন ক্রেতারা। বেলা গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে দোকানে দোকানে ভিড় বাড়তে থাকে। তবে ক্রেতাদের অভিযোগ, গত বছরের তুলনায় ইফতারসামগ্রীর দাম কিছুটা বেড়েছে।

শহরের ইফতারির আয়োজনে অতীত স্মৃতি তুলে ধরে প্রবীণ শিক্ষাবিদ, কবি ও কথাসাহিত্যিক বজলুল করিম বাহার প্রথম আলোকে বলেন, চল্লিশের দশকে বগুড়া শহরে কোনো ইফতারি বিক্রি হতো না। ঘরোয়াভাবে ইফতারি তৈরি হতো। কেউ চালের আটা সেদ্ধ করে মুঠা (একধরনের পিঠা) তৈরি করতেন। খেজুর বা আখের নলেন গুড় দিয়ে সেই মুঠা খেয়ে ইফতার সারতেন। কেউ আবার পাতে গুড়ে মাখা খই বা মুড়কি এবং দুধ-কলাতে ইফতার করতেন। হালুয়া রুটি বা ছাতু-গুড়েও ইফতার সারতেন কেউ কেউ। পঞ্চাশের দশকে বগুড়ার ইফতারির আয়োজনে যোগ হয় নারীদের হাতে তৈরি সেমাই। গুড়ের ক্ষীর এবং চিড়া-গুড়ও যোগ হয় ইফতারের আয়োজনে।

প্রবীণ ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ষাটের দশকে বগুড়া শহরে ইফতারি বিক্রি শুরু করে আকবরিয়া হোটেল। তখন আকবরিয়া হোটেলে ইফতারের আয়োজনে মিলত গরু-খাসির তেহারি, বিরিয়ানি, খিচুড়ি ও সেদ্ধ ছোলা–বুট। কাগজের ঠোঙা বা কলাপাতায় মিলত বিরিয়ানি। আরও পরে গুড়ের জিলাপি, বাতাসা, গুড়ের সন্দেশ যোগ হয় ইফতারের আয়োজনে। সত্তরের দশকে ইফতারের আয়োজনে রোজাদারদের কাছে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে ঐতিহ্যবাহী শাহি হালুয়া ও ফিরনি। আশির দশকে বগুড়ার ইফতারের আয়োজনের পরিধি বাড়তে শুরু করে। পবিত্র রমজান মাসে বেলা গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে হোটেল থেকে ফুটপাত—সর্বত্রই জমজমাট হয়ে ওঠে ইফতারির বাজার। বাহারি সব ইফতারির পসরা সাজিয়ে বসেন দোকানিরা। ইফতারের আয়োজনে এখন যোগ হয়েছে আস্ত খাসির কাবাব থেকে শুরু করে বাহারি সব খাবার।

রমজানের প্রথম দিনেই ইফতারি বেচাকেনা জমে উঠেছে। রোববার বিকেলে বগুড়া শহরের কবি নজরুল ইসলাম সড়কের একটি রেস্তোরাঁয়
ছবি: প্রথম আলো

ক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, শত বছরের ঐতিহ্যবাহী আকবরিয়া হোটেলের ইফতারের আয়োজনে জৌলুশ ছড়াচ্ছে টক দইয়ের ঘোল। হালুয়া-ফিরনি ফিরেছে নতুন স্বাদে, নতুন রূপে। আকবরিয়া ছাড়া এখন অন্যরাও বানাচ্ছে এই ঘোল। আলাদা স্বাদে, আলাদা দামে। তবে গ্লাসের বদলে ঘোল উঠেছে এখন প্লাস্টিকের বোতলে। আকবরিয়ার হাত ধরে হরেক স্বাদের বিরিয়ানি তৈরি করছে অন্যরাও। কোয়ালিটি সুইটসের শর্ষের তেল আর খাসির মাংসের ঝাল বিরিয়ানিও ক্রেতাদের পছন্দের তালিকায় উঠেছে। ইফতারে অন্য সব খাবারের পাশাপাশি এসব বিরিয়ানির অন্য রকম কদর।

রোববার বিকেলে আকবরিয়া হোটেলে গিয়ে দেখা যায়, ইফতারির ক্রেতাদের সামলাতে সবাই ব্যস্ত। বিক্রেতারা বললেন, ইফতারির ক্রেতার চাপ অন্য বছরের তুলনায় এবার বেশি। তবে শাহি বুন্দিয়া, শাহি জিলাপি, শাহি হালিম, হরেক রকমের কাবারের চাহিদাটা বেশি। প্রতি কেজি বুন্দিয়া, শাহি জিলাপি এখানে ২৬০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। ইফতারি কিনতে আসা উপশহরের বাসিন্দা আজমল হোসেন বলেন, ‘মুরগির রোস্ট, ছোলা, পেঁয়াজু, বুন্দিয়া, শাহি জিলাপি কিনেছি। এক ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে ইফতারি কিনতে হয়েছে। দামও এবার বেশি।’

আকবরিয়ার অন্যতম কর্ণধার হাসান আলী বলছেন, সব জিনিসের দাম বেড়েছে। তাই এর চেয়ে কমে তাঁরা বিক্রি করতে পারছেন না। তবু যাঁদের পছন্দ, তাঁরা কিনছেনই।

শহরের কাঁঠালতলা থেকে শুরু করে ফতেহ আলী মাজারের সামনে ফুটপাতে ইফতারির পসরা সাজিয়ে বসেছেন বিক্রেতারা। প্রতি কেজি বুন্দিয়া, বুট, জিলাপি ও ঝুরি এখানে ২২০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। ক্রেতারা বলছেন, অন্যবার ফুটপাতে ১৬০ টাকা কেজি দরে বুন্দিয়া মিলেছে। এবার ২২০ টাকার নিচে কোনো ইফতারসামগ্রী পাওয়া যাচ্ছে না।

একসঙ্গে ইফতার করছেন মুসল্লিরা। রোববার সন্ধ্যায় বগুড়া শহরের বায়তুর রহমান সেন্ট্রাল মসজিদে
ছবি: প্রথম আলো

বগুড়ার ইফতারের আয়োজনে হালিমের কদরও রয়েছে বেশ। হালিমের জন্য প্রসিদ্ধ শ্যামলী হোটেল, কোয়ালিটি সুইটস, চিটাগাং নুর হোটেল ও বারবিকিউ চায়নিজ রেস্তোরাঁ। বারবিকিউর ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবদুল বাসেদ বলেন, চারজনের খাওয়ার উপযোগী এক বাটি হালিলের দাম এখানে ৫০০ টাকা। হালিম ছাড়াও অর্ধশত পদের ইফতারির বাহারি খাবার এখানে সমান জনপ্রিয়।

শহরের জলেশ্বরীতলা এলাকায় অভিজাত রেস্তোরাঁর সামনে বসেছে বাহারি ইফতারির পসরা। এসব পসরায় প্রতি কেজি বুন্দিয়া, জিলাপিসহ ইফতারসামগ্রী প্রতি কেজি ৩০০ থেকে ৩২০ টাকায় দরে বিক্রি হয়েছে।

হোটেল লাভিস্তার সামনে ইফতারির অর্ধশত পদের বাহারি পসরা সাজানো হয়েছে। প্রতি কেজি ইফতারি এখানে ৩০০ থেকে ৫০০ টাকায় মিলছে। হোটেল লাভিস্তার কর্ণধার মো. রাব্বী বলেন, ইফতারের আয়োজনে নতুনত্বের পাশাপাশি গুণগত মান অক্ষুণ্ন রাখার চেষ্টা করা হয়েছে। এ কারণে দাম একটু বেশি।

হালিম কিনতে আসা জাকির হোসেন বললেন, ‘বগুড়ার ইফতারিতে শাহি হালিম অনন্য। তিন যুগ ধরে শাহি হালিম কিনছি, সেই স্বাদ, সেই ঘ্রাণ এখনো আছে।’