শিক্ষক–সংকট প্রকট, হয় না ক্লাস

চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার মানচিত্র

চাঁপাইনবাবগঞ্জের সবচেয়ে বড় বিদ্যাপীঠ নবাবগঞ্জ সরকারি কলেজ। শিক্ষার্থীর সংখ্যা ১০ হাজারের বেশি। তবে শিক্ষার্থীর অনুপাতে শিক্ষক–সংকট প্রকট। এ অবস্থা চলছে বহু বছর ধরে। শিক্ষার্থীদের পাঠদান থেকে বঞ্চিত শিক্ষার্থীরা প্রাইভেট পড়তে বাধ্য হচ্ছেন।

দর্শন বিভাগের স্নাতক চতুর্থ বর্ষের ছাত্রী সানজিদা খাতুন ও মানসুরা খাতুন। ৫ মার্চ তাঁরা কলেজে এসেছিলেন দীর্ঘ এক বছর পর। তাঁরা জানান, কলেজে ক্লাস হয় না ঠিকমতো। এ জন্য শিক্ষার্থীরাও ঠিকমতো কলেজে আসেন না। কোনো দিন দু-একজন এলেও শিক্ষার্থী স্বল্পতার কারণে শিক্ষকেরা ক্লাস নিতে অনীহা প্রকাশ করেন।

উচ্চমাধ্যমিক শ্রেণির বিজ্ঞান বিভাগের কয়েকজন শিক্ষার্থী জানায়, তাদের কোর্স দুই বছরের। কিন্তু ক্লাস হয় এক বছর। বছরজুড়েই কোনো না কোনো পরীক্ষা লেগেই আছে কলেজে। পরীক্ষায় দায়িত্ব পালনকারী শিক্ষকেরা ক্লাস নিতে পারেন না। এতে সিলেবাস সম্পন্ন হয় না। বাধ্য হয়েই তাদের প্রাইভেট পড়তে হয়। এমনকি উদ্ভিদবিদ্যা ও প্রাণিবিদ্যার মতো বিষয়গুলো প্রাইভেট না পড়েও যেখানে চালানো যায়, এসব বিষয়েও ক্লাস না হওয়ায় প্রাইভেট পড়তে হচ্ছে শিক্ষার্থীদের।

আগে অনার্সের ক্লাসগুলোতে ৪০-৪৫ জন শিক্ষার্থী পাওয়া যেত। এখন ২০ জনও পাওয়া যায় না। ঝরেও পড়ছে অনেকে। দ্বিতীয় বর্ষের মধ্যেই ঝরে পড়ে ৩০-৩৫ ভাগ। তাদের অনেকেই বিদেশে শ্রমিক হিসেবে কাজে চলে যায়।
আমিনুল ইসলাম, উপাধ্যক্ষ, নবাবগঞ্জ সরকারি কলেজ

তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি (আইসিটি) বিভাগে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ১ হাজার ৮৫০। শিক্ষক মাত্র একজন। এ বিভাগের প্রভাষক কেতাব আলীর কথায় ফুটে ওঠে অসহায়ত্ব। তিনি বলেন, একা পাঠদান সামলাতে হিমশিম খেতে হয়। বিভাগ চালাতে অফিস সহায়কেরও সহযোগিতা নিতে হয়। আর একজন শিক্ষক হলে ভালো হয়।

কলেজ কর্তৃপক্ষ জানায়, ১৯৫৫ সালে প্রতিষ্ঠিত এই কলেজ ১৯৭৯ সালে সরকারীকরণ করা হয়। কলেজে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ১০ হাজারের বেশি। ১৪টি বিষয়ে স্নাতক (সম্মান) ও চারটি বিষয় স্নাতকোত্তর পড়ানো হয়। রয়েছে উচ্চমাধ্যমিক ও স্নাতক (পাস) কোর্স। শিক্ষক–সংকটের কারণে কোনো শ্রেণিতে ঠিকমতো ক্লাস নেওয়া সম্ভব হয় না।

গত কয়েক দিন কলেজে সরেজমিন দেখা যায়, শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি খুবই কম। রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের স্নাতকোত্তরের একজন ছাত্র চূড়ান্ত পরীক্ষার প্রবেশপত্র নিয়ে ফিরছিলেন কলেজ থেকে। কলেজে ক্যাম্পাসেই কথা হয় তাঁর সঙ্গে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি মাস্টার্স পরীক্ষার্থী। কিন্তু কলেজে একটি দিনও ক্লাস করার সুযোগ পাইনি। ক্লাস হয় না বলে শিক্ষার্থীরাও কলেজে আসে না। নিজে নিজেই যা পেরেছি, পড়েছি। শিক্ষকদের কোনো সহযোগিতা পাইনি। কলেজ তো নয়, এ যেন কেবলই একটা পরীক্ষাকেন্দ্র।’

শিক্ষার্থীরা জানান, কলেজে অর্ধবার্ষিক, বার্ষিকসহ অন্যান্য পরীক্ষা থাকলে ক্লাস হয় না বললেই চলে। আর ক্লাস হয় না বলে স্নাতকের শিক্ষার্থীদের মধ্যে কলেজে আসার ও ক্লাস করার প্রবণতাও কম। এ জন্য কলেজে এক-চতুর্থাংশ শিক্ষার্থীও দেখতে পাওয়া যায় না।

গণিত বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক আশরাফুল ইসলাম বলেন, তাঁর বিভাগে শিক্ষকের ছয়টি পদের মধ্যে আছেন দুজন। জোড়াতালি দিয়ে চলছে বিভাগ। স্নাতক তৃতীয় ও চতুর্থ বর্ষে আটটি করে কোর্স। এর সঙ্গে আছে দুটি করে চারটি ব্যবহারিক কোর্স। তাঁরা কেবল দুটি করে চারটি কোর্স সম্পন্ন করতে পারেন। অন্যদিকে উচ্চমাধ্যমিকের দুটি বর্ষের চারটি শাখায় পড়াতে হয়। ঠিকমতো কোনোটাই হয় না।

হিসাববিজ্ঞান বিভাগের স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শ্রেণিতে শিক্ষার্থী রয়েছেন এক হাজার। উচ্চমাধ্যমিকে ৫০০ ও স্নাতক (পাস) শ্রেণিতে ১৫০ জন। সব মিলিয়ে ১ হাজার ৬৫০ শিক্ষার্থীর জন্য আছেন মাত্র দুজন শিক্ষক। এ বিভাগের প্রধান সহযোগী অধ্যাপক আবদুল খালেক চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘দুজন শিক্ষক মিলে ক্লাস নিই। বেছে বেছে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো পড়াই। শিক্ষার্থীরা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয় বটে। তবে প্রকৃত শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হয়।’

সব কটি বিভাগের শিক্ষক–সংকটের চিত্র দেন কলেজের উপাধ্যক্ষ আমিনুল ইসলাম। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, আগে অনার্সের ক্লাসগুলোতে ৪০-৪৫ জন শিক্ষার্থী পাওয়া যেত। এখন ২০ জনও পাওয়া যায় না। ঝরেও পড়ছে অনেকে। দ্বিতীয় বর্ষের মধ্যেই ঝরে পড়ে ৩০-৩৫ ভাগ। তাদের অনেকেই বিদেশে শ্রমিক হিসেবে কাজে চলে যায়। ক্লাসে উপস্থিতি বাড়াতে পদক্ষেপ গ্রহণের কথা ভাবা হচ্ছে।

উপাধ্যক্ষ জানান, যেসব বিভাগে অনার্স কোর্স চালু রয়েছে, সেসব বিভাগে দুজন অধ্যাপক, চারজন সহযোগী অধ্যাপক, ছয়জন সহকারী অধ্যাপক ও চারজন প্রভাষক মিলিয়ে মোট ১৬ জন শিক্ষক দরকার। বাংলা বিভাগে শিক্ষার্থী ২ হাজার ৬৫০ জন, শিক্ষক রয়েছেন ৭ জন। ইংরেজি বিভাগে শিক্ষার্থী ২ হাজার ৩৩০ জন, শিক্ষক রয়েছেন ৬ জন। দর্শন বিভাগে শিক্ষার্থী ১ হাজার ২৪০ জন। শিক্ষকের পদ পাঁচটি থাকলেও আছেন মাত্র দুজন। ইতিহাস বিভাগে শিক্ষার্থী ১ হাজার ১২০ জন। শিক্ষকের পদ রয়েছে পাঁচটি, কিন্তু শিক্ষক রয়েছেন তিনজন। অর্থনীতি বিভাগে শিক্ষার্থী ১ হাজার ২০০ জন। শিক্ষকের পদ পাঁচটি, আছেন চারজন। রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে শিক্ষার্থী ১ হাজার ৪৭৫ জন। শিক্ষকের পদ ছয়টি, কিন্তু আছেন চারজন। ব্যবস্থাপনা বিভাগে শিক্ষার্থী ১ হাজার ৩০০ জন। শিক্ষকের পদ রয়েছে ছয়টি, আছেন চারজন। হিসাববিজ্ঞান বিভাগে শিক্ষার্থী ১ হাজার ৩৭৫ জন। শিক্ষকের পদ রয়েছে ছয়টি, আছেন মাত্র দুজন। গণিত বিভাগে শিক্ষার্থী ১ হাজার ৩৬০ জন। শিক্ষকের পদ রয়েছে ছয়টি, আছেন মাত্র দুজন। পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে শিক্ষার্থী ১ হাজার ২০০ জন। শিক্ষকের পদ রয়েছে পাঁচটি, আছেন চারজন। রসায়ন বিভাগে শিক্ষার্থী ১ হাজার ২৪০ জন। শিক্ষকের পদ রয়েছে ছয়টি, আছের পাঁচজন। উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগে শিক্ষার্থী ১ হাজার ৪০০ জন। শিক্ষকের পদ রয়েছে ছয়টি, আছেন মাত্র দুজন। প্রাণিবিদ্যা বিভাগে শিক্ষার্থী ১ হাজার ৪০০ জন। শিক্ষকের পদ রয়েছে ছয়টি, আছের মাত্র তিনজন।

কলেজের অধ্যক্ষ সৈয়দ মো. মোজাহারুল ইসলাম অসহায়ত্বের কথা স্বীকার করে জানান, কলেজে শিক্ষকের পদ রয়েছে ৮১টি, রয়েছেন মাত্র ৫৪ জন। এর মধ্যে ৭ জন অধ্যাপক, ৪ জন সহযোগী অধ্যাপক ও ১৭ জন প্রভাষকের পদ শূন্য রয়েছে বহুদিন ধরে। বাস্তবে শিক্ষার্থী অনুপাতে আরও ১৪৯ জন শিক্ষকের প্রয়োজন। এর মধ্যে ২০ জন অধ্যাপক, সহযোগী অধ্যাপক ৪৯ জন, সহকারী অধ্যাপক ৬৫ জন ও প্রভাষক ২২ জন। এই হিসাব দিয়ে সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে চাহিদা পাঠানো হয়েছে।