বন ঘেঁষে অবৈধ ৫ করাতকল 

অবৈধ করাতকলের মালিকেরা কৌশল করে উচ্ছেদ ও মামলা থেকে বাঁচতে যৌথ মালিকানায় বীর মুক্তিযোদ্ধাদের অন্তর্ভুক্ত করেছে।

টাঙ্গাইলের সখীপুরে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের নাম দিয়ে সাইনবোর্ড ব্যবহার করে বনের ভেতর অবৈধভাবে করাতকল স্থাপন করা হয়েছেছবি: প্রথম আলো

টাঙ্গাইলের সখীপুরে সংরক্ষিত বনাঞ্চল ঘেঁষে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের নাম ব্যবহার করে অবৈধ পাঁচ করাতকল গড়ে উঠেছে। ওই সব করাতকলে দিনরাত দেদার বনের কাঠ চেরাই করা হচ্ছে। ফলে ধ্বংস হচ্ছে সংরক্ষিত ও সামাজিক বনায়ন। উপজেলার নলুয়া বিটের আওতাধীন বনাঞ্চলের পাশে ওই সব অবৈধ করাতকলের অবস্থান।

স্থানীয় বিট কর্মকর্তা এম এস জামান বলেন, বন আইনে করাতকল স্থাপনের বিধিমালা ৭-এর (ক)-তে বলা আছে, সংরক্ষিত বনাঞ্চলের কিংবা সামাজিক বনায়নের সীমানার ১০ কিলোমিটারের মধ্যে কোনো করাতকল স্থাপন করা যাবে না। বিধি ভেঙে করাতকলের মালিকেরা কৌশলে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের অংশীদার করায় ওই সব করাতকল উচ্ছেদ করতে গিয়ে তাঁরা ‘বিব্রত’ হচ্ছেন।

নলুয়া বিট কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্র জানায়, দুই বছর আগে এই বিটের আওতায় কমপক্ষে ১০টি অবৈধ করাতকল গড়ে ওঠে। বছরখানেক আগে স্থানীয় প্রশাসন ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান চালিয়ে ওই সব করাতকল উচ্ছেদ করে। এর কিছুদিন পর অবৈধ করাতকলমালিকেরা কৌশল করে উচ্ছেদ ও মামলা থেকে বাঁচতে যৌথ মালিকানায় বীর মুক্তিযোদ্ধাদের অন্তর্ভুক্ত করে। এখন ওই সব অবৈধভাবে স্থাপিত করাতকলের সামনে ‘মুক্তিযোদ্ধার করাতকল’ সাইনবোর্ড সাঁটিয়ে দেদার বনের কাঠ চেরাই করছে।

গত শনিবার বিকেলে ওই বিটে দেখা যায়, নলুয়া-বহুরিয়া সড়কে বিট কার্যালয় থেকে দুই কিলোমিটারের মধ্যে সংরক্ষিত বনাঞ্চল ঘেঁষে লাইলেন্সবিহীন পাঁচটি করাতকল গড়ে উঠেছে। ওই পাঁচটি করাতকলই পাঁচজন বীর মুক্তিযোদ্ধার নামে পরিচালিত হচ্ছে। তাঁরা হচ্ছেন বীর মুক্তিযোদ্ধা আলতাফ খান, বীর মুক্তিযোদ্ধা রফিকুল ইসলাম, সাবেক সেনাসদস্য বীর মুক্তিযোদ্ধা ফজলুল হক, বীর মুক্তিযোদ্ধা সানোয়ার হোসেন ও বীর মুক্তিযোদ্ধা আবু জাফর শামসুদ্দিন।

নলুয়া বিটের দেউদিঘী এলাকার করাতকলের সামনে গেলে চোখে পড়ে ‘বীর মুক্তিযোদ্ধা করাতকল’ লেখা একটি সাইনবোর্ড। সেখানে লেখা ‘প্রো. বীর মুক্তিযোদ্ধা আবু জাফর শামসুদ্দিন’। বীর মুক্তিযোদ্ধার বেসামরিক গেজেট ও লাল মুক্তিবার্তা নম্বরও ওই সাইনবোর্ডে লেখা রয়েছে।

করাতকলের চারজন শ্রমিক কাঠ চেরাই করছেন। মালিক কে, জিজ্ঞেস করলে দূরে এক ব্যক্তিকে দেখিয়ে দেন। ওই ব্যক্তির নাম আনোয়ার হোসেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘ঘেচুয়া গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা আবু জাফর শামসুদ্দিন আমাদের এ করাতকলের অংশীদার। তিনি কখনো এই করাতকল দেখতে আসেন না। তাঁর ফোন নম্বরও আমাদের কাছে নেই। মাস গেলে তাঁকে হিসাব করে লভ্যাংশ বুঝিয়ে দেওয়া হয়। বীর মুক্তিযোদ্ধা বলে তাঁকে মালিক হিসেবে রাখা হয়েছে।’

বীর মুক্তিযোদ্ধা আবু জাফর শামসুদ্দিনের মুঠোফোন সংগ্রহ করে তাঁকে ফোন দেওয়া হলে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি ওই করাতকলের অংশীদার। আমার ছেলে নেই। বুড়ো বয়সে আমার রোজগারের আর কোনো পথ নেই। স্বামী-স্ত্রী দুজনেই আমরা অসুস্থ। আমার নাম ব্যবহার করে ওরা আমাকে মাসে তিন হাজার টাকা দিচ্ছে।’

বহুরিয়া বাজারের করাতকল মালিক বীর মুক্তিযোদ্ধা সানোয়ার হোসেন বলেন, ‘আমরা বৈধভাবে ব্যবসা করছি। চুরি করে তো আর খাই না। বন বিভাগ আমাদের মৌখিকভাবে পারমিশন দিয়েছে।’

করাতকলের মালিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, প্রতিটি করাতকলে দৈনিক গড়ে ২০০ ঘনফুট কাঠ চেরাই করা হচ্ছে। বীর মুক্তিযোদ্ধাদের পাঁচটি করাতকলে মাসে ৩০ হাজার ঘনফুট ও বছরে ৩ লাখ ৬০ হাজার বর্গফুট কাঠ চেরাই করা হচ্ছে। এসব কাঠ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে পাচার হচ্ছে।

উপজেলা বৈধ করাতকল মালিক সমিতির সভাপতি জিন্নত আলী প্রথম আলোকে বলেন, বীর মুক্তিযোদ্ধা বলে তাঁরা আইনের বাইরে নন। তাঁদেরও সরকারি আইন মানতে হবে। আইন লঙ্ঘন করলে তাঁরাও অপরাধী হিসেবে বিবেচ্য হবেন। তাঁদের ২০ হাজার টাকা মাসে সম্মানী ভাতা দিচ্ছে সরকার। তাঁরা লাইসেন্সবিহীন ওই সব করাতকল অবৈধভাবে চালাতে পারেন না। টাস্কফোর্স গঠন করে অবৈধ করাতকল উচ্ছেদ করে তাঁদের বিরুদ্ধে মামলা দেওয়ার জন্য প্রশাসনকে তিনি আহ্বান জানান।

উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডের সাবেক কমান্ডার মো. ওসমান গনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘বীর মুক্তিযোদ্ধার নামে যাঁরা অবৈধভাবে করাতকল চালাচ্ছেন, তাঁরা প্রকারান্তরে মুক্তিযোদ্ধাদেরই অসম্মান করছেন। এসব মুক্তিযোদ্ধাকেও আইনের আওতায় নিয়ে বিচার হওয়া উচিত।’

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ও উপজেলা ভারপ্রাপ্ত কমান্ডার মোহাম্মদ হোসেন পাটোয়ারী প্রথম আলোকে বলেন, ‘পাঁচটি করাতকলের মালিক বীর মুক্তিযোদ্ধা কি না, খোঁজখবর নিয়ে পরবর্তী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। অবৈধ কাজে মুক্তিযোদ্ধারা জড়িত হলে তাঁদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এ ছাড়া উপজেলার সব অবৈধ করাতকল উচ্ছেদে শিগগিরই অভিযান চালানো হবে।