মাটির হাতি-ঘোড়া-গরু-খেলনা ক্রেতার বাড়ি যাওয়ার অপেক্ষায়
বাড়ির উঠানে বসে তৈরি করা মাটির তৈজসপত্রে রং করছেন খোকন পাল। আর রোদে এসব জিনিস শুকানোর জন্য দিচ্ছেন দীপালি পাল। ঈদ আর পয়লা বৈশাখকে ঘিরে বিভিন্ন স্থানে বসবে মেলা। সেসব মেলায় এসব তৈজসপত্র বিক্রি করতে নিয়ে যাওয়া হবে। বছরের এই সময়টাতেই মাটির জিনিসপত্র বেশি বিক্রি হয়। তাই পরিবারের অন্য সদস্যদের সঙ্গে তাঁরাও ব্যস্ত কাজে।
সম্প্রতি কিশোরগঞ্জের হাওর–অধ্যুষিত নিকলী উপজেলা সদরের ষাটধার পালপাড়ায় গিয়ে দেখা যায়, বাড়ির ছোট থেকে বড় সবাই এখন ব্যস্ত। এলাকার লোকজন বলেন, ঈদ ও বৈশাখী মেলার অপেক্ষায় এই পালপাড়ার ৩২টি পরিবার। অভাবের কারণে নানা টানাপোড়েনের কাটছে তাদের জীবন। একসময় এলাকায় হাজারো পরিবার এ পেশায় জড়িত ছিল। কিন্তু অনেকে টিকতে না পেরে এ পেশা ছেড়ে দিয়েছেন। এখন অল্প কয়েকটি পরিবার বাপ-দাদার এই পেশা আঁকড়ে ধরে আছে।
এখানকার বাসিন্দা অজিত পালসহ কয়েকজন বলেন, বর্তমানে মাটির অভাব আছে। পাশাপাশি সব জিনিসের দাম বেড়ে যাওয়ায় এসব খেলনা ও গৃহস্থালির তৈজসপত্র তৈরি করতে অনেক সমস্যা পোহাচ্ছেন তাঁরা। নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা এ পেশায় অনাগ্রহ প্রকাশ করছে। এ কারণেই পেশা এখন প্রায় বিলুপ্তির পথে।
গ্রাম ঘুরে দেখা যায়, চাকা ঘুরিয়ে কাদামাটি দিয়ে বিশেষ কায়দায় ফুলদানি তৈরি করছিলেন রঞ্জিত পাল। রোদে সেগুলো শুকিয়ে আবার আগুনে পোড়ানো হয়। এভাবে পরিবারের চার সদস্য নিয়ে বাহারি তৈজসপত্র তৈরি করেন তিনি। পরে সেগুলো রং করে গ্রামের বিভিন্ন মেলায় নিয়ে যান।
সবিরাণী পালও পরিবারের সদস্যদের নিয়ে কাদামাটি দিয়ে সব বাহারি পণ্য তৈরি করেছেন। তিনি বলেন, এসব পণ্য রোদে শুকিয়ে আগুনে পোড়ানো হয়েছে। এখন রং করার পর প্যাকেট করে গুছিয়ে নিয়ে যাওয়া হবে মেলায়। তাঁর আশা, বেচাবিক্রি যাতে ভালো হয়। নাহলে সন্তান আর পরিবার-পরিজন নিয়ে চলাটা তাঁদের জন্য কষ্টকর হবে।
পালপাড়া ঘুরে দেখা যায়, মৃৎশিল্পীরা প্লেট, গ্লাস, মগ, জগ, লবণের বাটি, সানকি (বাসন), কাপ-পিরিচ ও তরকারির বাটি তৈরি করেছেন। আরও আছে হাতি, ঘোড়া, গরু, হরিণ, সিংহ, বাঘ, ভালুক, জেব্রা, হাঁস, মুরগি। ছোট শিশুদের জন্য আরও আছে খেলনা হাঁড়ি-পাতিল ও বিভিন্ন ধরনের চুলা। নতুন নকশার কয়েলদানি, মোমদানি, ফুলদানি ও বাহারি রঙের মাটির ব্যাংক তৈরি করা হয়েছে।
পালপাড়ার মৃৎশিল্পীরা বলেন, সবার পছন্দমতো তাঁরা মাটির পণ্য গড়ার চেষ্টা করেছেন। নকশাতেও এনেছেন বৈচিত্র্য। যাঁরা দূরের মেলায় যাবেন, তাঁরা আগেই রওনা দিয়ে দিয়েছেন। আশা করছেন বিক্রি ভালো হবে। সামনে ঈদ। ঈদেও অনেকে নতুন ও ঘর সাজানোর জিনিস কেনেন। এরপর বৈশাখ। ফলে এবার ভালো বিক্রি হওয়ার আশা আছে।
খোকন পাল বলেন, এখন নানা সমস্যায় জর্জরিত তাঁরা। প্লাস্টিকের জিনিসের ভিড়ে মাটির তৈরি এসব হাঁড়ি-পাতিল, কলসির ব্যবহার কমে যাওয়ায় তাঁদের মতো মৃৎশিল্পীরা অন্য কাজে ঝুঁকে পড়ছেন। বর্তমানে হাতে গোনা কিছু এলাকায় মাটির জিনিস তৈরি হয়। তাঁরা অপেক্ষায় থাকেন কখন আসবে বৈশাখ, কখন আসবে মেলা। এ সময়ে যা লাভ হয়, তা দিয়েই চলে সংসার। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির এ বাজারে ধারদেনা করে অনেকটা দিশাহারা তাঁরা। উপকরণের দাম বেড়ে যাওয়ায় লাভও কম হচ্ছে। তাই বাপ-দাদার এ পেশাকে টিকিয়ে রাখতে সরকারের সুনজর দাবি করেন তাঁরা।
কিশোরগঞ্জ সমাজসেবা কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক মো. শহীদুল্লাহ বলেন, ‘সমাজসেবা অধিদপ্তর থেকে তাঁদের কয়েকজনকে সহায়তা করা হয়েছে, ক্রমান্বয়ে তাঁদের আরও সহায়তা করা হবে।’
এ বিষয়ে নিকলী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) পাপিয়া আক্তার বলেন, ‘বংশপরম্পরার ঐতিহ্যকে ধরে রাখতে সরকারিভাবে এসব মৃৎশিল্পীকে সহায়তা করা হবে। খোঁজখবর নিয়ে তাঁদের সহজ শর্তে ঋণের ব্যবস্থা করা হবে।’