‘সারা দিন নৌকায় থাকি’

সোমবার বেলা তিনটায় সব নদ-নদীর পানি বিপৎসীমার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হয়। চরাঞ্চলের বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত রয়েছে।

কুড়িগ্রাম জেলার মানচিত্র

কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার যাত্রাপুর ঘাট থেকে নৌকায় দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে গতকাল সোমবার ব্রহ্মপুত্র নদের দক্ষিণ বালাডোবার চরে গেলে চোখে পড়ে ঘরের ভেতর বুকসমান পানি। চরের বাসিন্দারা কেউ নৌকায়, কেউ ঘরের ভেতর চৌকি উঁচু করে বসবাস করছেন।

বাসিন্দা হজরত আলী বলেন, এখানে ২৫টি পরিবার বাস করে। পানি বাড়ায় কয়েকটি পরিবার অন্যত্র চলে গেছে। বাকিদের কোনো উপায় না থাকায় এখানেই আছে।

হজরত আলী আরও বলেন, ‘সারা দিন নৌকায় থাকি, রাইতোত ঘরে। চারপাশে খালি পানি আর পানি। দেওয়া (আকাশ) আন্ধার কইরা আসলে ডাকে, ঝড়ি–তুফান ওঠে, ভয় নাগে। ছাওয়াপাওয়াগুলাইল ভয়ে জড়ায় ধরে। ঠিকমতো খাওয়া-ঘুম নাই। পানির কল, পায়খানা ডুইবা আছে। বানের মধ্যে খুব কষ্টে আছি গো, বাবা।’

হজরত আলী আরও বলেন, তিনি বিভিন্ন জায়গা ঘুরে দিনমজুরি করেন। ঈদের আগে বাড়ি এসেছেন। তখন থেকে তিনি বেকার আছেন। এর মধ্যে ফসল ডুবে গেছে। বন্যার মধ্যে পরিবার ছেড়ে কোথাও যেতে পারছেন না। তিনি যা রোজগার করে এনেছিলেন, তার সব শেষ। ধার করে এখন কোনোরকমে চলছেন তিনি।

হজরত আলীর স্ত্রী লাল বানু বলেন, রান্না করে যে খাবেন, তার উপায় নেই। কোনোরকমে চুলা জ্বালিয়ে এক বেলা রান্না করেন। এলাকার আরেক বাসিন্দা ফরিদা বেগম বলেন, ‘বানে পানি খাওয়ার কল ডুবি গেইছে। পায়খানা ডুবি গেইছে।’

সেখান থেকে পূর্ব পাশে আধা কিলোমিটার দূরে বতুয়াতলী চরের কাছে যেতেই চোখে পড়ে এক লোক নৌকায় বেশ কিছু ছাগল নিয়ে নিরাপদ আশ্রয়ে যাচ্ছেন। আরেকটু দূরে দেখা যায়, অসংখ্য ঘরের অর্ধেক পানিতে ডুবে আছে। একটি উঁচু চালার নিচে অসংখ্য গবাদিপশু ও মানুষ।

হাশেম আলী নামের একজন বলেন, ‘কাশিয়া মাটি দিয়ে (কাশফুলের গাছ দিয়ে) জাগাটা উঁচা করছি। এখানে ৯ গৃহস্থ গরু-ছাগল রাখছে। সাথে আমরাও থাকি। গবাদিপশুগুলার খাবারের খুব কষ্ট। এক মাস থাকি ঘাস পানির নিচে।’

বুকসমান পানির মধ্যে দাঁড়িয়ে বৃদ্ধ হাবিবুর রহমান জানান, এখানে ৪৫টি পরিবার বসবাস করে। সবাই নদীভাঙনে ক্ষতিগ্রস্ত। আগে অন্য জায়গায় তাদের বাড়ি ছিল। গত বছর এ চরে এসে ঘর বানিয়েছে তারা।

আশপাশের মুসার চর, মশালের চর, সরকারপাড়া, ব্যাপারীপাড়া ঘুরে একই অবস্থা চোখে পড়ে। চরগুলো উলিপুর উপজেলার বেগমগঞ্জ ইউনিয়নের অধীন। মুঠোফোনে স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান বাবলু মিয়া বলেন, বেগমগঞ্জ ইউনিয়নে প্রায় ২ হাজার ২০০ পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর মধ্যে ৩০০ পরিবারকে ১০ কেজি করে চাল দেওয়া হচ্ছে।

প্রথম আলো চরে গিয়ে দেখা যায়, পানি কমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ভাঙন দেখা দিয়েছে। অনেকে ঘর সরিয়ে নিচ্ছেন। এ সময় আবদুর সোবান ব্যাপারী বলেন, ‘৩০ বছর থাকি আছি। এবারে প্রথম ভাঙনের মুখে পড়লাম। ৫০টা পরিবারের এই দুরবস্থা। তবু কেউ খোঁজ নেয় নাই।’

কুড়িগ্রামের পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) জানায়, সোমবার বেলা তিনটায় সব নদ-নদীর পানি বিপৎসীমার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হয়। চরাঞ্চলের বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত রয়েছে। এ ছাড়া ২০ কিলোমিটার এলাকায় ভাঙন চলছে। এক মাসে জেলায় ১ হাজার ৬৬০টি পরিবার নদীভাঙনে বসতবাড়ি হারিয়েছে।

জেলা প্রশাসন জানায়, বন্যায় জেলার ৭৩টি ইউনিয়নের মধ্যে ৪৫টি ইউনিয়নের ১৮৫ গ্রাম সম্পূর্ণ ও আংশিক প্লাবিত হয়েছে। ৬১ হাজার ৫৪ জন বন্যাকবলিত হয়েছে। বন্যার্ত মানুষের জন্য জেলায় মোট ৩৬১টি অস্থায়ী আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। এর মধ্যে ২১টি আশ্রয়কেন্দ্রে ১৮০টি পরিবার আশ্রয় নিয়েছিল। এর মধ্যে ৫২টি পরিবার বন্যা পরিস্থিতি উন্নতি হওয়ায় বাসায় চলে গেছে।

জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ সাইদুল আরীফ জানান, পানি কমে যাওয়ায় পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে। বন্যার্ত ও নদীভাঙনকবলিত মানুষের জন্য এখন পর্যন্ত ৩৬৩ মেট্রিক টন চাল, নগদ ৯ লাখ টাকা ও শুকনা খাবার বিতরণ করা হয়েছে।