বাজারই ‘অবৈধ’, তার জন্য নদীতে ঘাট দিচ্ছে বন্দর

চট্টগ্রাম নগরের ফিশারিঘাটের নতুন মাছবাজারের জন্য কর্ণফুলী নদীতে নির্মাণ করা হচ্ছে ঘাট। এর অংশ হিসেবে নদীতে দেওয়া হচ্ছে গাছের খুঁটি। গত মঙ্গলবার বেলা একটায়ছবি: সৌরভ দাশ

কর্ণফুলী নদীর চট্টগ্রাম নগর অংশে দখল করে গড়ে ওঠা অবৈধ স্থাপনার তালিকায় রয়েছে ফিশারিঘাট নতুন মাছবাজারটি। অন্য জায়গায় বাজার স্থানান্তর করে সব অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদের নির্দেশনা রয়েছে আদালতের। কিন্তু এখন এই ‘অবৈধ’ বাজারের সুবিধার জন্য নদী দখল করে পাকা ঘাট নির্মাণ করে দিচ্ছে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ।

বাজারের জন্য ঘাট নির্মাণ করার কথা শুরুতে জানত না চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন। নির্মাণকাজ শুরু হলে খবর পেয়ে ৪ ফেব্রুয়ারি ম্যাজিস্ট্রেট পাঠিয়ে কাজ বন্ধের নির্দেশ দেওয়া হয়।

বন্দর সূত্র জানায়, গত ১৭ জানুয়ারি বন্দর কর্তৃপক্ষ ফিশারিঘাট-সংলগ্ন নদীতে ঘাট নির্মাণ করার জন্য রেইনবো এন্টারপ্রাইজ নামে একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি করে। বন্দরের পক্ষে প্রধান প্রকৌশলী মাহমুদুল হোসেন খান ও ঠিকাদারের পক্ষে স্বত্বাধিকারী মেজবাহ উদ্দিন আহমেদ সই করেন। ঘাটটি নির্মাণে ব্যয় ধরা হয় ৮৮ লাখ ৪৪ হাজার ১৫০ টাকা। চুক্তি সইয়ের পরদিন থেকে নির্মাণকাজ শুরু হয়।

কর্ণফুলী নদী দখল করে গড়ে ওঠা অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ এবং নতুন নতুন দখল ঠেকানোর দাবিতে চট্টগ্রাম বন্দর ভবনের সামনে গত বুধবার দুপুরে অবস্থান ধর্মঘট পালন করেছে নদী ও খাল রক্ষা আন্দোলনসহ চারটি পরিবেশবাদী সংগঠন। এরপর শনিবার মাছবাজার পরিচালনা কমিটি সোনালী যান্ত্রিক মৎস্যজীবী সমবায় সমিতি এক মতবিনিময় সভা করে বাজারটি অপসারণ করা হলে তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলা হবে বলে ঘোষণা দেয়।

ফিশারিঘাটের নতুন মাছবাজারটি নিয়ন্ত্রণ মৎস্যজীবী লীগের নগর সভাপতি আমিনুল হক ওরফে বাবুল সরকারের হাতে। তিনি ফিশারিঘাট সোনালী যান্ত্রিক মৎস্যজীবী সমবায় সমিতির সাধারণ সম্পাদক। নগর রাজনীতিতে তিনি চট্টগ্রাম নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছির উদ্দীনের অনুসারী। এখন মাছবাজারে ট্রলার থেকে মাছ ওঠানামা সহজ করতে নতুন করে ঘাটটি নির্মাণ করা হচ্ছে। আমিনুল হকের লোকজন নির্মাণকাজ তদারক করছেন।

ঘাট নির্মাণের বিষয়ে জানতে চাইলে সোনালী যান্ত্রিক মৎস্যজীবী সমবায় সমিতির সাধারণ সম্পাদক আমিনুল হক বলেন, ‘মাছ নিয়ে উঠতে কষ্ট হয়। তাই বন্দর এই সিঁড়ির ঘাট নির্মাণ করে দিচ্ছে। আমাদের হাত নেই এখানে। আর বাজার উচ্ছেদের বিষয়টি বন্দর ও জেলা প্রশাসন জানে।’

এর আগে গত বছরের জানুয়ারিতে উচ্ছেদ তালিকায় থাকা এই বাজারে নতুন করে পাকা স্থাপনা গড়ে তুলছিলেন আমিনুল হক। পরে জেলা প্রশাসন তা উচ্ছেদ করে।

২০১৫ সালের ডিসেম্বরে চাক্তাই ও রাজাখালী খালের মধ্যবর্তী স্থানের নদী অংশে জেগে ওঠা চর বন্দর কর্তৃপক্ষ ফিশারিঘাটকে ইজারা দেয়। এর আয়তন ৩ দশমিক ৯৭ একর। ইজারা পাওয়ার অন্তত দেড় বছর আগে থেকে সেখানে বাজার কার্যক্রম চলে আসছিল। বর্তমানে দুই শতাধিক দোকানপাট রয়েছে।

২০০ মিটার দূরত্বে মনোহরখালী এলাকায় আরেকটি বড় মাছবাজার থাকার পরও এই ইজারার প্রতিবাদ করে নদী রক্ষা আন্দোলনসহ বিভিন্ন পরিবেশবাদী সংগঠন, যা গড়ায় আদালত পর্যন্ত। আদালত বাজারটি অবৈধ উল্লেখ করে উচ্ছেদের নির্দেশনা দিয়েছিলেন।

জেলা প্রশাসনও উচ্ছেদের নোটিশ দেয়। এরপর বাজারের পক্ষে দুই দফা আপিল করা হয়। এখন শেষ আপিলটি বিচারাধীন।

জানতে চাইলে জেলা প্রশাসক আবুল বাসার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামান বলেন, ‘মাছবাজারটি উচ্ছেদ তালিকায় রয়েছে। তবে জায়গা প্রাপ্তি সাপেক্ষে তাদের উচ্ছেদ করতে বলা হয়েছে। ওখানে নতুন স্থাপনা করার সংবাদ পেয়ে ম্যাজিস্ট্রেট পাঠিয়েছিলাম। কাজ বন্ধ রাখতে বলা হয়েছে। নদীতে কোনোভাবে স্থাপনা করা যাবে না, এ নিয়ে হাইকোর্টের নির্দেশনা রয়েছে।’

জেলা প্রশাসন কাজ বন্ধ রাখার কথা বললেও ৫ ফেব্রুয়ারি দুপুরে সরেজমিনে দেখা যায়, দক্ষিণ পাশে নদীর পানির অংশে প্রায় ৩০ ফুট নেওয়া হয়েছে ঘাটের জন্য। বাজারের সঙ্গে ট্রলারের সংযোগ করার জন্য এই ঘাট করা হচ্ছে। প্রাথমিকভাবে পানিতে গাছের খুঁটি পোঁতা হচ্ছে। এ জন্য পাইলিংয়ের কাজ চলছে। অবশ্য জেলা প্রশাসনের তৎপরতার কারণে তিন দিন ধরে সেখানে ঘাটের নির্মাণকাজ বন্ধ রয়েছে বলে স্থানীয় লোকজন জানান।  

ঘাট নির্মাণের ব্যাপারে চট্টগ্রাম বন্দরের সচিব ওমর ফারুক প্রথম আলোকে বলেন, ‘মৎস্যজীবীদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে এই ঘাট নির্মাণ করে দেওয়া হচ্ছে। বাজার অবৈধ তালিকায় হয়তো থাকতে পারে। আমার জানা নেই।’

কর্ণফুলী নদীর অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদের জন্য মানবাধিকার ও পরিবেশবাদী সংগঠন হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশ (এইচআরপিবি) কাজ করছে ২০১০ সাল থেকেই। ওই বছর এইচআরপিবির পক্ষে আইনজীবী মনজিল মোরসেদ উচ্চ আদালতে একটি রিট আবেদন করেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে জেলা প্রশাসন আদালতে নদীর ২ হাজার ১১২টি অবৈধ স্থাপনার তালিকা জমা দেয়। এর মধ্যে ফিশারিঘাট মাছবাজার অন্যতম। ২০১৬ সালে আদালত কর্ণফুলীর অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদের জন্য নির্দেশ দেন। কিছুদিন চলার পর উচ্ছেদ কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়।

এই বাজারসহ আট শতাধিক অবৈধ স্থাপনা এখনো উচ্ছেদ হয়নি। জেলা প্রশাসনের দাবি, কিছু স্থাপনা নিয়ে মামলাসংক্রান্ত জটিলতা থাকায় উচ্ছেদ করা হয়নি।  

নদীতে নতুন করে ঘাট নির্মাণের বিষয়টি আইনজীবী মনজিল মোরসেদ জেলা প্রশাসনকে অবহিত করেছেন। জানতে চাইলে মনজিল মোরসেদ প্রথম আলোকে বলেন, বাজারটি অবৈধ স্থাপনার অন্তর্ভুক্ত। এটা উচ্ছেদ করতে আদালত নির্দেশ দিয়েছিলেন। পরে তারা আবার আদালতের শরণাপন্ন হয়। এখন নতুন করে নদীতে কেউ স্থাপনা গড়ে তুলতে পারবেন না। বন্দরের এই স্থাপনা নির্মাণ বা অনুমতি দেওয়ার কোনো ক্ষমতা নেই। বন্দর নাব্যতা রক্ষার জন্য কাজ করবে।