কক্সবাজারের দরিয়ানগরের শাহেনশাহ গুহা কেন পর্যটকদের হতাশ করছে
কক্সবাজারের ‘দরিয়ানগর ট্যুরিজম ইকোপার্ক’ পর্যটনপল্লির শাহেনশাহ গুহা একসময় পর্যটকদের প্রধান আকর্ষণ ছিল। এখন এই পর্যটনপল্লির ইটপাথরের হাঙর ভাস্কর্য, পাকা সিঁড়ি, বসার চৌকি অযত্ন-অবহেলায় ধ্বংস হচ্ছে। পাহাড়ের বড় বড় গাছ নেই। তাতে ভূমিধসের ঘটনায় সুড়ঙ্গটিও রক্ষা পাচ্ছে না। সব মিলিয়ে হতাশ পর্যটকেরা।
কক্সবাজার শহরের কলাতলী হাঙর ভাস্কর্য মোড় থেকে কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিন ড্রাইভ ধরে দক্ষিণ দিকে ছয় কিলোমিটার গেলে দরিয়ানগর সমুদ্রসৈকত। সৈকতের পূর্ব পাশে পাঁচটি পাহাড়ের সমন্বয়ে গড়ে উঠেছে ‘দরিয়ানগর ট্যুরিজম ইকোপার্ক’। তবে সবাই চেনে ‘দরিয়ানগর পর্যটনপল্লি’ নামে। এই পল্লির মূল আকর্ষণ পাহাড়ের নিচে ৪০০ বছরের পুরোনো প্রায় ৭০০ ফুট দৈর্ঘ্যের প্রাকৃতিক একটি গুহা বা সুড়ঙ্গ। যার নাম—শাহেনশাহ গুহা।
পাহাড়ের নিচে সাপের মতো আঁকাবাঁকা পথের সুড়ঙ্গটি দেখতে কয়েক বছর আগেও প্রতিদিন এক হাজারের বেশি পর্যটকের সমাগম ঘটত, এখন হাতে গোনা কয়েকজন দর্শনার্থী আসেন। সুড়ঙ্গটি সংস্কারের উদ্যোগ না নেওয়া এবং নিরাপত্তাহীনতা এর অন্যতম কারণ। সুড়ঙ্গটি দেখতে গিয়ে প্রায়ই পর্যটকেরা হয়রানির শিকার হন বলে অভিযোগ রয়েছে।
সম্প্রতি পার্কটিতে গিয়ে দেখা যায়, প্রধান ফটকে স্থাপন করা হয়েছে ইটপাথরের বিশাল একটি হাঙর ভাস্কর্য। মুখ হাঁ করে থাকা হাঙর দেখে দর্শনার্থীরা থমকে দাঁড়ান। ভাস্কর্যটির সঙ্গে ছবি তুলছেন পর্যটকদের অনেকেই। সেখান থেকে পাহাড়ের দিকে কিছু দূর গেলেই সামনে পড়ে একটি সিঁড়ি। ওপরে টাঙানো একটি সাইনবোর্ড, তাতে লেখা—আমরা এখন দরিয়ানগরে। এর কিছু দূরে পাহাড়চূড়ায় নির্মিত একটি ভবন, যেখানে শৌচাগার-বিশ্রামাগার রয়েছে। তবে ভবনটিতে গিয়ে হতাশ হন দর্শনার্থীরা, কারণ সেটি তালাবদ্ধ। ভবন থেকে দক্ষিণ দিকে সুড়ঙ্গে যেতে হয় কাদাযুক্ত পাহাড়ি রাস্তায় হেঁটে।
সরেজমিনে দেখা যায়, সুড়ঙ্গের মুখ থেকে শেষ প্রান্ত পর্যন্ত পুরো পথটি ময়লা-আবর্জনায় ভরপুর। সুড়ঙ্গের দুই পাশ ও ওপর থেকে মাটি খসে পড়ছে। ভেঙে পড়া গাছপালা সুড়ঙ্গের পথে ও ওপরে পড়ে আছে। এসব মাড়িয়েই সুড়ঙ্গটি অতিক্রম করতে হচ্ছে দর্শনার্থীদের। সুড়ঙ্গের ভেতরে গিয়ে দুই যুবকের সঙ্গে দেখা হয়। তাঁদের হাতে লাঠি।
সুড়ঙ্গের ভেতরে কথা হয় ঢাকার উত্তরা এলাকার ব্যবসায়ী হাবিবুর রহমানের সঙ্গে। তিনি বলেন, পাঁচ বছর আগে তিনি প্রথমবার সুড়ঙ্গটি দেখতে এসেছিলেন ১০ জনের একটি দল নিয়ে। সুড়ঙ্গ দেখে তখন সবাই মুগ্ধ হয়েছিল। এবার সুড়ঙ্গ দেখার জন্য চারজনকে নিয়ে এসেছেন। সুড়ঙ্গের প্রবেশমুখ পর্যন্ত এসেই চারজন হতাশ, তাঁরা আর সুড়ঙ্গেই ঢোকেননি। তিনি নিজে একা সুড়ঙ্গে ঢুকেছেন ভেতরের অবস্থা দেখতে। হাবিবুর রহমান বলেন, পর্যটনপল্লিতে ইটপাথরের হাঙর ভাস্কর্য, পাকা সিঁড়ি, বসার চৌকি তৈরি হলেও দর্শনার্থীর পছন্দের জায়গাটা (সুড়ঙ্গ) অযত্ন-অবহেলায় ধ্বংস করে ফেলা হচ্ছে। পাহাড়ের বড় বড় গাছগুলো এখন নেই। তাতে ভূমিধসের ঘটনায় সুড়ঙ্গটিও রক্ষা পাচ্ছে না।
পর্যটনকেন্দ্রটিতে নারায়ণগঞ্জের স্কুলশিক্ষক কামরুল আজম বলেন, পাহাড়ের কিছু গাছপালা ভেঙে গুহার মুখে আটকে আছে। পলিথিন, ক্যান, সিগারেট ফিল্টার, প্লাস্টিকের বোতল গুহার ভেতরে হাঁটার রাস্তায় পড়ে আছে। ময়লা–আবর্জনা এবং মশা-মাছির উৎপাত চারদিকে। গুহাটিতে নিরাপত্তা বলতেও কিছুই নেই।
দর্শনার্থীরা জানান, পাহাড়চূড়ার ভবনটির সামনের খোলা মাঠে দাঁড়িয়ে কিংবা চেয়ারে বসে পশ্চিম দিকের সৈকতে সূর্যাস্ত উপভোগ করা যেত। এখন জায়গাটি জঙ্গল হয়ে আছে। আগে পশ্চিম পাশের ২৫০ ফুট উঁচু পাহাড়চূড়ায় বিশ্রামের জন্য একাধিক টংঘর ছিল। সে ঘরে বসে বঙ্গোপসাগরের দৃশ্য, সৈকতে প্যারাসেলিং এবং পর্যটকদের দৌড়ঝাঁপ দেখা যেত। এখন কিছুই নেই। পাহাড়চূড়ায় ওঠার রাস্তা বা সিঁড়ি ধ্বংস হয়ে গেছে।
কামরুল হাসান নামের স্থানীয় একজন বাসিন্দা ও সংস্কৃতিকর্মী বলেন, একটা সময় এই শাহেনশাহ গুহাকে ঘিরে দেশ-বিদেশের কবি-সাহিত্যিকদের মেলা বসত। কবিরা পাহাড়চূড়ার টংঘরে বসে লেখালেখি করতেন। দেশ-বিদেশের শতাধিক কবি-সাহিত্যিককে নিয়ে দরিয়ানগর পর্যটনপল্লিতে বার্ষিক সম্মেলন করা হতো। এখন সেই পরিবেশও নেই।
সুড়ঙ্গসহ পর্যটনকেন্দ্রটি দেখভাল করে কক্সবাজার দক্ষিণ বন বিভাগের সদর রেঞ্জ কর্মকর্তা মো. হাবিবুল হক। সুড়ঙ্গসহ পল্লির বেহালের কারণ জানতে চাইলে হাবিবুল হক প্রথম আলোকে বলেন, বরাদ্দ নেই বলে সুড়ঙ্গ সংস্কার ও মেরামত করা যাচ্ছে না। গাছ ভেঙে সুড়ঙ্গে পড়লে কিংবা সুড়ঙ্গে ময়লা–আবর্জনা জমে থাকলে সেসব পরিষ্কার করার দায়িত্ব ইজারাদারের। পর্যটকের নিরাপত্তার দায়িত্বও ইজারাদারের। আগামী ফেব্রুয়ারি মাসে ইজারার মেয়াদ শেষ হবে। তখন সুড়ঙ্গের ঝুঁকিপূর্ণ অংশ সংস্কার, যাতায়াতের রাস্তা তৈরি করা হবে।
গত জুলাই মাসজুড়ে কক্সবাজারে ভারী বৃষ্টি হয়েছে। বৃষ্টিতে সুড়ঙ্গের মাটি ধসে পড়ছে। কিন্তু বরাদ্দ না থাকায় সংস্কার করা যাচ্ছে না জানিয়ে কক্সবাজার দক্ষিণ বন বিভাগের সহকারী বন সংরক্ষক (এসিএফ) শ্যামল কুমার ঘোষ বলেন, বরাদ্দ পেলে সুড়ঙ্গ রক্ষার কাজে হাত দেওয়া হবে।