হাঁড়িভাঙার রাজ্যে ব্যস্ততা, বেচাকেনা হবে ১৫০ কোটি টাকার
রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলার খোঁড়াগাছ ইউনিয়নের পাইকারহাটের আমচাষি মো. নুরুজ্জামান (৬৫)। ওই এলাকায় দুই একর আয়তনের আমবাগান চার লাখ টাকায় এক মৌসুমের জন্য ভাড়া নিয়েছেন তিনি। চলতি মাসের শেষের দিকে আম সংগ্রহ শেষে বাগান ফেরত দেবেন তিনি। শেষ মুহূর্তে এখন তাঁর নাওয়া-খাওয়া চলছে আমবাগানেই।
আর কদিন পর শুরু হবে হাঁড়িভাঙা আমের ভরা মৌসুম। তাই নুরুজ্জমানের মতো হাজারো আমচাষির এখন ব্যস্ততা হাঁড়িভাঙা আম ঘিরে।
মিঠাপুকুরের খোঁড়াগাছ, ময়েনপুর, চ্যাংমারী, বালুয়া মাসুমপুর; বদরগঞ্জের কুতুবপুর, গোপালপুর, লোহানীপাড়া, রামনাথপুর, কালুপাড়া ইউনিয়নের বিভিন্ন এলাকায় হাঁড়িভাঙা আমের চাষ হয়েছে প্রচুর। এসব এলাকা যেন এখন হাঁড়িভাঙা আমের রাজ্য। গতকাল বুধবার সরেজমিনে দেখা গেল, আমবাগানের মালিক, আমের ফড়িয়া, আমবাগানের পরিচর্যায় নিয়োজিত ব্যক্তি, মৌসুমি আম বিক্রেতা, অনলাইনে আম বিক্রেতা, পরিবহন ব্যবসায়ী, কুরিয়ার সার্ভিস ব্যবসায়ী—সবাই যে যাঁর মতো করে আম কেনাবেচার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
রংপুরের দর্শনা রোড হয়ে পালিচড়া পার হয়ে পারকারহাটের দিকে এগোলে চোখে পড়ে রাস্তার দুই ধারে সারি সারি হাঁড়িভাঙা আমবাগান। গাছে থোকায় থোকায় আম। বাড়ির ভেতরে, উঠানে, রাস্তায়—সবখানে হাঁড়িভাঙা আমগাছ। অধিকাংশ চাষি অপেক্ষা করছেন আম পরিপক্ব হতে কৃষি বিভাগের বেঁধে দেওয়া সময়ের জন্য। তবে কেউ কেউ আম পাড়া শুরু করেছেন। তাঁরা বলেছেন, অতিরিক্ত গরমে এ বছর নির্ধারিত সময়ের আগে আম পাকা শুরু হয়েছে।
প্রতিবছর আমচাষি ও ব্যবসায়ীদের সঙ্গে মতবিনিময় করে হাঁড়িভাঙা বাজারে আসার তারিখ ঘোষণা করে জেলা প্রশাসন। তবে এ বছর এমন উদ্যোগ এখনো দেখা যায়নি। জেলা ও উপজেলা কৃষি বিভাগ ১৫ জুনের পর ‘পরিপক্ব’ আম বাজারজাত করতে আমবাগানের মালিক ও ব্যবসায়ীদের পরামর্শ দিচ্ছে।
মিঠাপুকুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মুহাম্মদ সাইফুল আবেদীন প্রথম আলোকে বলেন, আগের বছরগুলোতে ১৫ থেকে ২০ জুনের মধ্যে হাঁড়িভাঙা আম বাজারে আনার তারিখ দেওয়া হয়েছিল। সে হিসেবে কৃষি বিভাগের পক্ষ থেকে ১৫ জুনের পরে গাছ থেকে আম সংগ্রহের কথা বলা হচ্ছে।
মালদিয়া থেকে হাঁড়িভাঙা
হাঁড়িভাঙা আমের নাম আগে ছিল মালদিয়া। হাঁড়িভাঙা নামকরণের সঙ্গে জড়িয়ে আছে মিঠাপুকুর উপজেলার খোঁড়াগাছের তেকানী গ্রামের নফল উদ্দিন পাইকারের নাম। তিনি ছিলেন এক বৃক্ষপ্রেমিক।
নফল উদ্দিনের ছেলে আমজাদ হোসেন পাইকার জানান, সালটি সম্ভবত ১৯৪৯। মিঠাপুকুরের উঁচা বালুয়া গ্রামটি ছিল ঝোপজঙ্গলে ভরপুর। সেখান থেকে একটি আমের চারা নিয়ে এসে কলম করেন তাঁর বাবা। আমগাছটিতে মাটির হাঁড়ি বেঁধে পানি দেওয়া হতো। একদিন রাতে কে বা কারা হাঁড়িটি ভেঙে ফেলে।
আমজাদ হোসেন বলেন, গাছটিতে একসময় প্রচুর পরিমাণ আম ধরে। খেতে খুবই সুস্বাদু। বিক্রির জন্য বাজারে নিয়ে গেলে লোকজন এই আম সম্পর্কে জানতে চান। তখন তাঁর বাবা মানুষকে বলেন হাঁড়িভাঙা গাছের আম এগুলো। তখন থেকেই গাছটির আম হাঁড়িভাঙা নামে পরিচিতি পায়। শুধু তা–ই নয়, এটি পরিণত হয়েছে রংপুরের ‘ব্র্যান্ডে’। পেয়েছে জিআই পণ্যের স্বীকৃতিও। নফল উদ্দিনের বাড়ির হাঁড়িভাঙা আমের মাতৃগাছটি এখনো বেঁচে আছে।
এবার লেনদেন হবে ১৫০ কোটি টাকার
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হিসাবে, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে জেলায় হাঁড়িভাঙা আম আবাদ করা জমির পরিমাণ ১ হাজার ৯১৫ হেক্টর। এর মধ্যে মিঠাপুকুরে ১ হাজার ২৬৮। জেলায় সম্ভাব্য হাঁড়িভাঙা আমের উৎপাদন ধরা হয়েছে ২৯ হাজার ৮৫১ মেট্রিক টন।
আমচাষি, ব্যবসায়ী ও কৃষি বিভাগের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গড়ে ৫০ টাকা কেজি ধরলেও হাঁড়িভাঙা আমকে কেন্দ্র করে রংপুরে এ মৌসুমে প্রায় ১৫০ কোটি টাকার লেনদেন হবে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের রংপুরের উপপরিচালক মো. সিরাজুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, হাঁড়িভাঙা আমের মাধ্যমে রংপুরের কৃষি অর্থনীতি চাঙা হয়েছে। এ বছর আমগাছে মুকুল কম এলেও আমের আকার ভালো হয়েছে। তবে অতিরিক্ত গরমের কারণে নির্ধারিত সময়ের আগে হাঁড়িভাঙা বাজারে এসেছে। আমের চাহিদা ও জোগানের ওপর আম চাষি ও ব্যবসায়ীদের লাভ-লোকসান বোঝা যাবে।
কীটনাশকের ব্যবহার বেড়েছে
স্থানীয় সূত্র জানায়, বাণিজ্যিকভাবে আম উৎপাদন শুরু হওয়ার কীটনাশকের ব্যবহার বেড়েছে। কয়েকজন আমচাষি প্রথম আলোকে বলেন, গাছ থেকে আম সংগ্রহের ৮-১০ আগেরও অনেকে ছত্রাকনাশক কীটনাশক স্প্রে করেন।
কথা হয় খোঁড়াগাছ ইউনিয়নের উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা মামুনুর রশিদের সঙ্গে। তিনি বলেন, আমবাগানে রাসায়নিক সার ও কীটনাশক কম ব্যবহার করতে কৃষকদের উদ্বুদ্ধ, চাষি প্রশিক্ষণ ও প্রদর্শনী করে থাকেন। বিষমুক্ত আম উৎপাদনে উত্তম কৃষিচর্চা নিয়ে তাঁরা কৃষকদের সঙ্গে কাজ করছেন। আম সংগ্রহের অন্তত ২০-২৪ দিন আগে থেকে কোনো কীটনাশক ব্যবহার না করতে চাষিদের বলা হয়। কিন্তু অতিরিক্ত প্রতিযোগিতার কারণে কীটনাশকের ব্যবহার কমানো যাচ্ছে না।
আসছেন ব্যবসায়ীরা
মিঠাপুকুরের খোঁড়াগাছ ইউনিয়নের পদাগঞ্জ হাঁড়িভাঙা আমের প্রধান ব্যবসাকেন্দ্র। দেশের বিভিন্ন এলাকার আম ব্যবসায়ীরা এখানে আসেন মৌসুম শুরুর পাঁচ-সাত দিন আগে। তাঁরা ঘর ভাড়া নিয়ে সেখানে থাকেন।
পদাগঞ্জ বাজারে আমের আকার ও মানভেদে ১ হাজার ৫০০ থেকে ২ হাজার ৫০০ টাকা মন বিক্রি হচ্ছে। রংপুরের পীরগঞ্জ উপজলা থেকে আম কিনতে এসেছেন ব্যবসায়ী মোহাম্মদ ইউসুফ। তিনি ২০০ কেজি আম কিনে বাসে করে সিলেটে পাঠাবেন বলে জানালেন।
পদাগঞ্জের ব্যবসায়ীরা জানান, হাঁড়িভাঙা আমের মৌসুমে পদাগঞ্জ থেকে পাঁচ-ছয়টি কুরিয়ার সার্ভিস প্রতিষ্ঠান সারা দেশে ভোক্তা পর্যায়ে আম পৌঁছে দেয়।
সুন্দরবন কুরিয়ার সার্ভিসের কর্মী রূপক ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, গত মৌসুমে শুধু সুন্দরবন কুরিয়ারে পদাগঞ্জ থেকে ৬০ লাখ টাকার হাঁড়িভাঙা সরবরাহ করেছেন তাঁরা।
শুরু হয়েছে আম সংগ্রহ
খোঁড়াগাছ মণ্ডলপাড়া হয়ে পদাগঞ্জের দিকে যেতে কয়েকটি বাগানে আম সংগ্রহ করতে দেখা গেল। হুমায়রা বেগম নামের এক নারী বললেন, তাঁর ছেলে মোনতিজিল আলম আমের ব্যবসা করেন। তাঁদের নিজের ও ভাড়া আমবাগান মিলে ৫০০-৬০০ আমগাছ। ভরা মৌসুমে ছোট বাগানের আম সংগ্রহ কঠিন হয়ে পড়ে। তাই আগে থেকে আম বিক্রি করছেন।
পার্শ্ববর্তী গ্রামের রুবেল ইসলাম বলেন, অতিরিক্ত গরমে আম পাকতে শুরু করেছে। সে জন্য বিক্রি করছেন।
পদাগঞ্জ বাজারে ব্যবসায়ীদের ভোগান্তি
স্থানীয় ব্যবসায়ী ও বাগানমালিকেরা বলছেন, আম বাজারজাতকরণ নিয়ে বেশি সমস্যা হয় পদাগঞ্জ বাজারে। পদাগঞ্জ হাঁড়িভাঙা আমের প্রধান বাণিজ্যিক কেন্দ্র হওয়ায় মিঠাপুকুর, বদরগঞ্জ ছাড়া বিভিন্ন এলাকার ছোট ছোট ব্যবসায়ী আমবাগানের মালিকদের কাছ থেকে আম কিনে পদাগঞ্জে বিক্রি করতে আসেন। কিন্তু হাটে সামান্য বৃষ্টি হলে পানি জমে থাকে। বাজারে শেড নেই। কাদা-পানিতে চলাচল কঠিন হয়ে পড়ে। ট্রাক, পিকআপ চলাচলের রাস্তা সরু, খানাখন্দে ভরা। এতে আম কিনতে এসে পরিবহন নিয়ে ভোগান্তিতে পড়েন ব্যবসায়ীরা।
আম ব্যবসায়ী মানিক মিয়া প্রথম আলোকে বলেন, প্রতিবছর জেলা প্রশাসক ও ইউএনও আমচাষি ও ব্যবসায়ীদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন। রাস্তাঘাট ভাঙা থাকলে তাৎক্ষণিকভাবে কিছু সংস্কারের ব্যবস্থা করেন। তবে এ বছর রাস্তা সংস্কারের কোনো উদ্যোগ চোখে পড়েনি।
জানতে চাইলে মিঠাপুকুরের সহকারী কমিশনার (ভূমি) মো. মুলতামিস বিল্লাহ (উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার দায়িত্বে) প্রথম আলোকে বলেন, জেলা প্রশাসকের সঙ্গে কথা বলে তাঁরা সেখানে গিয়ে সমস্যাগুলো সমাধানের চেষ্টা করবেন।
হিমাগারের দাবি
মিঠাপুকুরের দুজন উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা বললেন, হাঁড়িভাঙা আম খেতে সুস্বাদু। একেকটি আম ৩০০ থেকে ৫০০ গ্রাম হয়। কিন্তু এই আম গাছ থেকে সংগ্রহের চার-পাঁচ দিনের মধ্যে পেকে যায়। এ কারণে প্রতি মৌসুমে প্রচুর আম নষ্ট হয়।
স্থানীয় ব্যক্তিরা জানান, হাঁড়িভাঙা আম সংরক্ষণের জন্য এ অঞ্চলে একটি বিশেষায়িত হিমাগারের দাবি দীর্ঘদিনের। গত বছরের ২১ জুন মিঠাপুকুরের পদাগঞ্জে এসে ‘জিআই পণ্য হাঁড়িভাঙা আম মেলা ও প্রদর্শনী’র উদ্বোধন করে বিশেষায়িত হিমাগারের ঘোষণা দেন তৎকালীন কৃষিমন্ত্রী আব্দুস শহীদ। তবে হিমাগার স্থাপন নিয়ে মিঠাপুকুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (অতিরিক্ত দায়িত্বে) মো. মুলতামিস বিল্লাহ ও উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মুহাম্মদ সাইফুল আবেদীন সরকারের কোনো উদ্যোগের কথা জানাতে পারেননি।