দেড় যুগ ধরে বধ্যভূমি পরিচর্যা করছেন ‘গোলাম নবী’
মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় হানাদার বাহিনী ও অবাঙালি বিহারিরা মুক্তিকামী নিরীহ-নিরস্ত্র বাঙালিদের ওপর নির্যাতন ও হত্যাযজ্ঞ চালানোর জন্য রাজবাড়ী পৌরসভার বিনোদপুর লোকোশেড ব্যবহার করত। বিভিন্ন স্থান থেকে মুক্তিকামী বাঙালিদের ধরে এনে এখানে হত্যার পর তাঁদের কূপে ফেলে দেওয়া হতো। রাজবাড়ীর সবচেয়ে বড় বধ্যভূমি হিসেবে পরিচিত লোকোশেডে প্রায় ২১ বছর আগে সরকারি অর্থায়নে নির্মিত হয় বধ্যভূমি স্মৃতিসৌধ।
রাজবাড়ী পৌরসভার ৩ নম্বর ওয়ার্ড বিনোদপুর লোকোশেড বধ্যভূমি স্মৃতিসৌধ এলাকায় বহিরাগতদের অবাধ বিচরণের কারণে কয়েক বছর আগে জেলা প্রশাসন আলোকসজ্জাসহ সৌন্দর্যবর্ধনের কাজ করে। দীর্ঘদিন ধরে অধিকাংশ লাইটপোস্টগুলো অকেজো হয়ে আছে। দেখভালের তেমন কেউ না থাকায় এটি অনেকটা অযত্ন–অবহেলায় রয়েছে।
তবে স্থানীয় বিনোদপুর লোকোশেড এলাকার বাসিন্দা দরিদ্র রিকশাচালক ‘শেখ গোলাম নবী’ স্মৃতিসৌধ নির্মাণের প্রায় তিন বছর পর থেকে বিনা বেতনে এটি দেখভাল করছেন। সৌন্দর্যবর্ধনের কাজটিও তিনি করছেন। বিভিন্ন প্রজাতির ফুল গাছের চারা রোপণ করেছেন। ভালো লাগার জায়গা থেকে তিনি এ কাজ করেন। অথচ আক্ষেপ, তাঁর খোঁজ কেউ রাখেন না। প্রায় ১৮ বছর বিনা পারিশ্রমিকে তিনি স্মৃতিসৌধটি দেখভাল করছেন। তাঁর দাবি, ভাতার ব্যবস্থা করলে পরিবার নিয়ে মৃত্যুর আগে সচ্ছলতার সঙ্গে চলতে পারতেন।
সম্প্রতি লোকোশেড বধ্যভূমিতে দেখা যায়, বধ্যভূমি স্মৃতিসৌধের ভেতর ফুলগাছের পরিচর্যা করছেন শেখ গোলাম নবী। তাঁর ভেতর শিশুরা খেলাধুলা করছে। এ সময় গোলাম নবীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, রাতের বেলায় স্মৃতিসৌধে বহিরাগত বখাটে, মাদকসেবীদের আড্ডা বেড়ে যায়। অপরাধীদের আনাগোনা কমাতে স্মৃতিসৌধের চারপাশে ১২টি লাইটপোস্ট বসানো রয়েছে। কিন্তু দুই-তিনটি ছাড়া বাকি সব লাইটপোস্ট অকেজো হয়ে আছে।
১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় লোকোশেড এলাকায় মো. আতাউর রহমান, মোহাম্মদ আফসার উদ্দিন, শেখ জালাল উদ্দিন, আবদুল হাকিম মিয়া, মজিবর রহমান প্রামানিক, মো. ফিরোজ খান টোনা, মোহাম্মদ আমিনুল ইসলাম বাবুল, আবদুস সালাম মিয়া, মো. আমির আলী, আবদুল কুদ্দুস মিয়া, মোহাম্মদ আতাউর রহমানসহ অনেকে শহীদ হন।
স্থানীয় বাসিন্দা টোকেন মোল্লা বলেন, দুই-তিনটি ছাড়া অন্য লাইটপোস্টের একটি লাইটও জ্বলে না। রাতে নেশাখোর ও ছিনতাইকারীদের আনাগোনা বেড়ে যায়। তারা মাঝেমধ্যে পথচারীদের কাছ থেকে টাকাপয়সা কেড়ে নেয়। এ ছাড়া ১৪ ডিসেম্বর, ১৬ ডিসেম্বর, ২৬ মার্চসহ জাতীয় অনুষ্ঠানের সময় অনেক লোকজন আসা–যাওয়া করেন।
স্থানীয় বিদ্যুৎ কুমার সাহা বলেন, রাতের বেলায় মাঝেমধ্যে অনেকের কাছ থেকে সব জিনিসপত্র কেড়ে নেয় ছিনতাইকারীরা। লাইট যদি সব নষ্টই থাকে, তাহলে এগুলো এখানে দিছে কী কারণে।
শেখ গোলাম নবী বলেন, বাবা শেখ আলী আকবর লোকোশেডে চাকরি করতেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় মুক্তিযোদ্ধাদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সহযোগিতা করতেন। লোকোশেডে হানাদার বাহিনীর ক্যাম্পে বিভিন্ন অঞ্চল থেকে নিরীহ বাঙালিদের ধরে এনে নির্যাতনের পর হত্যা করা হতো। কাগজপত্র না থাকায় মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় বাবা শেখ আলী আকবরের নাম নেই। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি সম্মান ও ভালো লাগার জায়গা থেকে স্মৃতিসৌধ নির্মাণের পর ১৮ বছর ধরে তিনি (গোলাম নবী) এটা নিজে দেখভাল করছেন।
আক্ষেপের সুরে গোলাম নবী বলেন, ‘প্রতিবছর ১৪ ডিসেম্বর শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস, ১৬ ডিসেম্বর মহান বিজয় দিবস, ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবসের সময় প্রশাসন থেকে পরিষ্কার–পরিচ্ছন্ন করা হয়। বিশেষ এই দিনগুলোতে অন্তত ৬০-৭০টি গাড়ি আসে, অনুষ্ঠান শেষে আবার চলে যায়। একেকটি গাড়ি থেকে ১ টাকা করে দিলেও ৭০ টাকা পেতাম। সারা বছর কারও কোনো খবর থাকে না। না হলে মাদকসেবী, ছিনতাইকারীরা সব খুলে নিয়ে যেত। নিজের টাকায় গাঁদা, গোলাপ, রজনীগন্ধাসহ নানা জাতের ফুলগাছ রোপণ করেছি। নিয়মিত পানি দিই, যত্ন করে থাকি। এখন ফুল ফুটছে, অনেক সুন্দর লাগছে। আমি দরিদ্র রিকশাচালক। বয়সের ভারে নিয়মিত রিকশা চালাতে পারি না। বড় দুটি ছেলে তারা রিকশা চালায়, পৃথক থাকে। যদি সরকারিভাবে ভাতার ব্যবস্থা হতো, অন্তত মৃত্যুর আগে পরিবার নিয়ে সচ্ছলতার সঙ্গে চলতে পারতাম।’
রাজবাড়ীর জেলা প্রশাসক সুলতানা আক্তার বলেন, ‘গোলাম নবী নিজ উদ্যোগে লোকোশেড বধ্যভূমি স্মৃতিসৌধ দেখাশোনা করেন। বিষয়টি জানার পর এ বছর পবিত্র ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহায় আর্থিক অনুদান দিয়েছি। তিনি যেহেতু আমাদের নিয়োগকৃত কোনো কর্মচারী নন, তারপরও যত দিন এই জেলায় আছি জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে সহযোগিতা করা হবে। এ ছাড়া অকেজো লাইটপোস্টগুলো দ্রুত মেরামত করাসহ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’