ময়মনসিংহের সবজির ‘রাজ্যেও’ আনন্দ নেই কৃষকের

ময়মনসিংহ সদর উপজেলার বোররচর ইউনিয়নের কুষ্টিয়াপাড়া গ্রামের কৃষিজমিগুলোর অন্তত ৬০ শতাংশে টমেটোর চাষ করা হয়েছে। ছবি: আনোয়ার হোসেন।

সকাল সাড়ে ১০টা বাজলেও কুয়াশা কাটেনি। বইছিল হিমশীতল বাতাস। এর মধ্যে অনেকের কাজে নামার এক প্রহর শেষ হয়ে গেছে। বাড়ি থেকে আনা ভাত খেতে বসেছেন তাঁরা। যাঁরা একটু দেরি করে কাজে লেগেছেন, তাঁরা তখনো গভীর মনোযোগ দিয়ে খেত থেকে টমেটো তুলে বড় একটি স্তূপে এনে জড়ো করছেন।

গত বুধবার সকালে এমন দৃশ্যের দেখা মেলে ময়মনসিংহ সদর উপজেলার বোররচর ইউনিয়নের কুষ্টিয়াপাড়া গ্রামে। ব্রহ্মপুত্র নদের চরে অবস্থিত কুষ্টিয়াপাড়া ছাড়াও পার্শ্ববর্তী ডিগ্রিপাড়া, সিংঙ্গীমারী, বৈঠামারী, চররাঘবপুর, বনপাড়া, কান্দাপাড়া, বাত্তিপাড়া, মৃধাপাড়া, বাগের কান্দা, জাফরকান্দা পাড়া, ফকিরপাড়া, মধুমারী ও গাঙপাড়া গ্রামের মানুষ এখন সবজি তোলায় ব্যস্ত।

কুষ্টিয়াপাড়ার একটি খেতে টমেটো তুলছিলেন তামান্না আর মুনমুন নামের দুই বোন। তাঁদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, খেতটি তাঁদের নিজেদের নয়। অন্যের খেতে চার দিন ধরে টাকার বিনিময়ে টমেটো তুলে দিচ্ছিলেন তাঁরা। এই মৌসুমে গ্রামের যাঁরা ঢাকা বা অন্য জেলায় কাজ করেন, তাঁরাও ছুটি নিয়ে গ্রামে আসেন সবজি তোলার কাজ করতে।

সবজিচাষিরা জানান, চলতি মৌসুমে কৃষিজমিগুলোর অন্তত ৬০ শতাংশে টমেটোর চাষ করা হয়েছে। এ ছাড়া কাঁচা মরিচ, বাঁধাকপি, ফুলকপির আবাদ হয়েছে। এখন টমেটো পাকার ভরা মৌসুমে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত চাষিরা সবজিখেতেই কাটান। খেতে পানি দেওয়া, সবজি ওঠানো এবং বিক্রিতে কাটছে তুমুল ব্যস্ত সময়। এসব সবজি ঢাকা, কুমিল্লা, সিরাজগঞ্জ, চাঁপাইনবাবগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় যায়। প্রতিদিন সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত অন্তত ১৫০টি ছোট-বড় আকারের ট্রাক স্থানীয় তিনটি বাজার থেকে এসব সবজি কিনে নিয়ে যায়।

কৃষকেরা জানান, এত কর্মব্যস্ত দিনের শেষেও যেন আনন্দ নেই তাঁদের মনে। কারণ, বিনিয়োগের তুলনায় দাম কম পাচ্ছেন তাঁরা।

কুষ্টিয়াপাড়া গ্রামের কৃষক জাহিদ হাসান প্রথম আলোকে বলেন, টমেটোর বিদেশি জাতের বীজ দিয়ে তিনি চাষ শুরু করেন। মাত্র ৫ গ্রাম বীজের দাম ৫০০ টাকা। এরপর ফসল হওয়া পর্যন্ত সার, কীটনাশক, শ্রমিকের মজুরিসহ নানা খরচ। কিন্তু বিক্রির সময় দাম ভালো পাওয়া যায় না। বুধবার তিনি ১৫ টাকা কেজি দরে টমেটো বিক্রি করেন।

অথচ একই দিন ময়মনসিংহের বিভিন্ন বাজারে ৩০ থেকে ৪০ টাকা কেজি দরে টমেটো বিক্রি হচ্ছিল।

টমেটো ছাড়াও ফুলকপি আর বাঁধাকপির দামও তুলনামূলক কম বলে জানান কৃষকেরা। খেত থেকে ফুলকপি আর বাঁধাকপি তুলে নিয়ে যেতে হয় কাছারি বাজার অথবা গুচ্ছগ্রাম বাজারে। বাজারে নিতেও খরচ হয়। এরপর প্রতিটি কপির দাম পড়ে ১০ থেকে ১৫ টাকা। অথচ বাজারে বর্তমানে ফুলকপি আর বাঁধাকপির ন্যূনতম দর ৩০ টাকা।

ময়মনসিংহ সদর উপজেলার বোররচর ইউনিয়নের কৃষকদের উৎপাদিত এসব টমেটো দেশের বিভিন্ন জেলায় যায়
ছবি: আনোয়ার হোসেন।

কৃষকেরা জানান, মধ্যস্বত্বভোগীদের বিষয়টি তাঁরাও বোঝেন। কিন্তু কম দামে সবজি বিক্রি করা ছাড়া তাঁদের কোনো উপায় থাকে না। কারণ, এ এলাকায় উৎপাদিত সবজি সংরক্ষণের জন্য কোনো হিমাগার নেই। হিমাগার থাকলে লাভজনক দামে সারা বছর ধরে নিজেদের সবজি বিক্রি করতে পারতেন।

আসলাম আহমেদ নামে একজন কৃষক বলেন, ‘বছরে মাত্র একবার আমরা সবজি করতে পারি। বাকি সময় ব্রহ্মপুত্রের চরের ওই সব খেত পানিতে ডুবে থাকে। হিমাগার করে সবজি সংরক্ষণ করা হলে কৃষকদের খুব উপকৃত হতো।’