নেত্রকোনায় বন্যার পানি নামছে, ভেসে উঠছে ক্ষত
ভারী বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে সৃষ্ট বন্যায় কয়েক দিন ধরে বিপর্যস্ত ছিল নেত্রকোনার পাঁচটি উপজেলার অনন্ত ২৫টি ইউনিয়নের নিম্নাঞ্চল। চার দিন ধরে নামতে শুরু করেছে সেই পানি। এর মধ্য দিয়ে ভেসে উঠছে ক্ষতচিহ্ন।
স্থানীয় কয়েকজন বাসিন্দা বলেন, প্লাবিত গ্রামগুলোর অধিকাংশ সড়ক ভেঙে গেছে। পচে গেছে আমন ধান ও সবজিখেতের ফসল। ভেসে গেছে খামারের মাছ। বিধ্বস্ত হয়েছে প্রচুর ঘরবাড়ি। খড় নষ্ট হওয়ায় গোখাদ্যের সংকট দেখা দিয়েছে। এখনো বন্ধ আছে ২১২টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। এ ছাড়া কলমাকান্দা হরিণধরা গ্রামে শুক্রবার সকালে ডিঙিনৌকায় করে দুর্গাপূজা দেখতে যাওয়ার সময় নৌকা ডুবে দুই শিক্ষার্থীর মৃত্যু হয়েছে।
স্থানীয় বাসিন্দা ও জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, ৬ অক্টোবর নেত্রকোনার কলমাকান্দা, দুর্গাপুর, পূর্বধলা, বারহাট্টা ও সদর উপজেলায় বন্যা হয়। এতে প্রায় ১৩১টি গ্রাম প্লাবিত হয়। গত মঙ্গলবার থেকে পানি কমতে শুরু করেছে। গতকাল বৃহস্পতিবার রাত আটটার পর থেকে উব্দাখালী নদীর পানি কলমাকান্দা ডাকবাংলো পয়েন্টে বিপৎসীমার নিচে যায়। এ ছাড়া কংস, সোমেশ্বরী, ধনুসহ জেলার ছোট-বড় সব নদ নদীর পানি কমছে।
এখনো বিভিন্ন রাস্তাঘাট, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, আমন ধান খেত, শাকসবজিখেত, ঘরবাড়িতে পানি আছে। প্রায় ৪৮ হাজার মানুষ পানিবন্দী। পানির কারণে প্রায় ২৭০ কিলোমিটার গ্রামীণ কাঁচা–পাকা সড়ক যোগাযোগব্যবস্থা স্বাভাবিক হয়নি।
শুক্রবার বিকেলে এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত জেলা কৃষি অধিদপ্তরের তথ্যমতে, অন্তত সাড়ে ২২ হাজার হেক্টর আমন ধানখেত পানিতে নিমজ্জিত রয়েছে। এসব খেতের ধান গাছ পচে নষ্ট হয়ে গেছে। এতে প্রায় ২৯৩ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে বলে জানান জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর কার্যালয়ের উপপরিচালক মো. নুরুজ্জামান। তিনি জানান, ১৮৭ হেক্টর জমির সবজিও বন্যার পানিতে নষ্ট হয়ে গেছে।
পূর্বধলা উপজেলার জারিয়া এলাকার কৃষক মফিজ উদ্দিন বলেন, ফসলের ওপর ভিত্তি করে তাঁর সংসার চলে। এবার ১০ একর জমিতে আমন ধান আবাদ করেছিলেন। সব খেতের ধান পানিতে পচে নষ্ট হয়ে গেছে। ছেলেমেয়েদের পড়ালেখা ও সংসারের খরচ কীভাবে চালাবেন, কিছুই বুঝতে পারছেন না। খড় পচে যাওয়ায় গরুর খাবার নিয়েও সমস্যার মধ্যে আছেন।
খেতে সবজি নষ্ট হওয়ায় এর প্রভাব পড়েছে জেলার হাটবাজারগুলোতে। স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এক সপ্তাহ ধরে প্রতিটি সবজির দাম বেড়েছে কেজিতে দ্বিগুণ থেকে তিনগুণের কাছাকাছি। বাজারে শুধু পেঁপে ছাড়া আর কোনো সবজিই ৮০ টাকা কেজি নিচে পাওয়া যাচ্ছে না।
ধান আবাদের পাশাপাশি অনেক কৃষকই পুকুরে মাছ চাষ করেন। বন্যার পানিতে প্রায় দেড় হাজার পুকুরের মাছ ভেসে যায়। জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. শাহজাহান কবির জানান, সব মিলে মাছের ক্ষতি হয় প্রায় ৯ কোটি টাকা।
স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর নেত্রকোনার কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী মোহাম্মদ রবিউল ইসলাম বলেন, যেসব সড়ক থেকে বন্যার পানি নেমেছে, সেসব সড়কের প্রাথমিক হিসাব অনুযায়ী প্রায় ১২২ কোটি টাকার মতো ক্ষতি হয়েছে।
কলমাকান্দা উপজেলার কৈলাটি ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান জয়নাল আবেদীন বলেন, বন্যার পানি কয়েক দিন ধরে নেমে যাচ্ছে। কিন্তু ফসল আর রক্ষা হলো না। এখনো অনেক সড়কে পানি থাকায় চলাফেরা করতে সমস্যা হচ্ছে। চলতি বছর তৃতীয়বারের মতো বন্যা হওয়ায় এলাকার মানুষের প্রচুর ক্ষতি হয়েছে।
লেংগুরা ইউপি চেয়ারম্যান সাইদুর রহমান বলেন, পানি নেমে গেলেও টাকার অভাবে অনেকেই বিধ্বস্ত ঘরবাড়ি সংস্কার করতে পারছেন না। মানুষ পরিষদে এসে ত্রাণের জন্য ভিড় জমাচ্ছেন।
জেলা প্রশাসক বনানী বিশ্বাস বলেন, বন্যার পানি এখন দ্রুতই নেমে যাচ্ছে। আশা করছেন, সম্মিলিত প্রচেষ্টায় অল্প সময়ের মধ্যে সবকিছু স্বাভাবিক হয়ে যাবে। যাঁদের ফসলের ক্ষতি হয়েছে, যাঁদের ঘরবাড়ি নষ্ট হয়েছে, তাঁদের তালিকা তৈরি করে প্রশাসনের পক্ষ থেকে সহযোগিতা করা হবে। এ পর্যন্ত ১০০ মেট্রিক টন চাল, শিশুখাদ্য ও গোখাদ্যের জন্য নগদ পাঁচ লাখ টাকাসহ শুকনো খাবার বিতরণ করা হয়েছে। চাহিদা অনুযায়ী বরাদ্দ আরও বাড়ানো হবে।