যে প্রতিষ্ঠান স্বপ্ন দেখাচ্ছে পিছিয়ে পড়া নারীদের

গরবাখানা রেস্তোরাঁর অন্দরসজ্জায় আছে গ্রামীণ সংস্কৃতির ছাপপ্রথম আলো

কলাপাতা, ঝাউগাছ, মোরগফুল আর বাগানবিলাসে ঘেরা আঙিনা। সেখানে বুনো ছন, বাঁশ ও টিনের তৈরি একটি দোচালা ঘর। চারপাশের পাকা দেয়ালে আলপনা করা। চালায় ঝুলছে বেত ও বাঁশের তৈরি নানান গ্রামীণ কুটিরশিল্প। ভেতরে আড্ডা দিচ্ছেন কয়েকজন নারী-পুরুষ। বসার চেয়ার-টেবিল বাঁশ ও কাঠের তৈরি। সেই সঙ্গে চলছে খাবার পরিবেশন।

চট্টগ্রামের লোহাগাড়া উপজেলা সদর থেকে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়ক হয়ে পাঁচ কিলোমিটার দক্ষিণে চুনতি হাজী রাস্তার মাথা। সেখান থেকে সমশু হাজী সড়ক ধরে এক কিলোমিটার পূর্বে গেলেই চুনতি গ্রামের সিকদার পাড়া এলাকায় ফসলি জমির পাশে দেখা মেলে গ্রামীণ এ রেস্তোরাঁটির। নাম ‘গরবাখানা’। রেস্তোরাঁটির পেছনে রয়েছে গ্রামের পিছিয়ে পড়া নারীদের হাসি, কান্না ও শ্রমের গল্প। সুবিধাবঞ্চিত নারীদের কর্মসংস্থানের উদ্দেশ্যে প্রতিষ্ঠানটি গড়ে তুলেছে চুনতি উইমেন ফোরাম নামের একটি সংগঠন।

গরবাখানা মানে অতিথিশালা বা অতিথি আলয়। পরিচ্ছন্নতা, খাবারের মান ও সাশ্রয়ী দামের জন্য গরবাখানা নামের রেস্তোরাঁটি স্থানীয় বাসিন্দাদের কাছে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। লোহাগাড়ার প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকেও লোকজন খাবার খেতে আসেন এখানে। প্রতিদিন গড়ে তিন শতাধিক ক্রেতা আসেন গরবাখানায়। সব ধরনের খাবারে শিক্ষার্থীরা পান বিশেষ ছাড়। বাবুর্চি, পরিবেশক ও ব্যবস্থাপকসহ আটজন কর্মকর্তা-কর্মচারী রয়েছেন এখানে। সাধারণত সকাল ৬টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত খোলা থাকে গরবাখানা।

সকালের নাশতা হিসেবে বিক্রি হয় রুটি, পরোটা, ভাজি, ঘুগনি, স্যুপ ও পিঠা। সন্ধ্যায় বিক্রি হয় ফুচকা, চটপটি, কাবাব ও চিকেন মাসালা। এ ছাড়া সব সময় পাওয়া যায় ভুনা খিচুড়ি, ডালপুরি, শিঙাড়া, সমুচা, দই, বার্গার, পিৎজা, লাচ্ছি ও ফলের শরবত। রমজান উপলক্ষে প্রতিদিন বিক্রি হচ্ছে ইফতারসামগ্রী।

চুনতি সরকারি মহিলা কলেজের অধ্যক্ষ মো. গিয়াস উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘যখনই সময় পাই, গরবাখানায় ছুটে যাই। প্রতিষ্ঠানটি আশপাশের পাঁচ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের কাছেও জনপ্রিয়।’

চুনতি উইমেন ফোরামের সভাপতি বিশ্বব্যাংকের লিড ফাইন্যান্সিয়াল ম্যানেজমেন্ট স্পেশালিস্ট সুরাইয়া জান্নাত। তিনি বলেন, কোনো ছুটিতে গ্রামের বাড়িতে এলেই অসংখ্য অসহায় নারী সাহায্যের জন্য ছুটে আসতেন তাঁর কাছে। একপর্যায়ে তিনি উপলব্ধি করেন বারবার আর্থিক দান দিয়ে তাঁদের জীবনমানের উন্নয়ন করা সম্ভব নয়। এসব নারীকে স্থায়ীভাবে স্বাবলম্বী করার চিন্তা থেকেই গত বছরের ২৩ এপ্রিল গরবাখানার জন্ম। ১০ বছরের জন্য প্রায় পাঁচ লাখ টাকা ব্যয়ে ছয় শতক জায়গা ভাড়া নিয়ে গড়ে ওঠে গরবাখানা। এ কাজে অর্থায়ন করেছে চুনতি উইমেন ফোরাম।

চুনতি উইমেন ফোরামের সদস্য ৩০ জন সচ্ছল নারী। তাঁরা সংগঠনে মাসিক চাঁদা দেন। তাঁদেরই অর্থায়নে আরও অনেক নারী উদ্যোক্তা হওয়ার স্বপ্ন দেখছেন। ধীরে ধীরে একটি লাভজনক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে গরবাখানা। শুরুতে প্রতিষ্ঠানটি নিয়ে অনেক সংগ্রাম করতে হয়েছে বলে জানালেন এখানকার নারীরা।

গরবাখানা সূত্রে জানা যায়, প্রতিষ্ঠার পর এ পর্যন্ত অন্তত ২০ জন সুবিধাবঞ্চিত নারীকে ছাগল পালন, কাপড় সেলাই, মসলা ও আচার প্রস্তুতকরণ কার্যক্রমে বিনা সুদে অর্থায়ন করা হয়েছে। কিস্তিতে অর্থায়নের টাকা পরিশোধ করেন নারীরা। এ ছাড়া পাঁচজন গৃহহীন নারীকে গৃহ নির্মাণে অফেরতযোগ্য এককালীন সহযোগিতা দিয়েছে গরবাখানা। অসুস্থ নারীদের চিকিৎসাসেবা, দরিদ্র ছাত্রীদের শিক্ষা কার্যক্রমেও এককালীন অর্থায়ন করা হয়। চুনতি উইমেন ফোরাম পরিচালিত মরফুয়া জেবুন্নেছা মহিলা এতিমখানা স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসাপড়ুয়া ৪০ জন ছাত্রীর নিবাস। গরবাখানার লাভের একটি অংশ ওই এতিমখানাতেও দেওয়া হয়।

চট্টগ্রামের লোহাগাড়ায় নারী উন্নয়নের জন্য প্রতিষ্ঠিত রেস্তোরাঁ গরবাখানা
প্রথম আলো

চুনতি উইমেন ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সানজিদা রহমান বলেন, ‘গরবাখানা নারীদের জন্য নারীদের প্রতিষ্ঠান। আমরা চেয়েছিলাম নারী কর্মচারী দ্বারা এটি পরিচালিত হবে। কিন্তু সামাজিক প্রতিবন্ধকতার কারণে আমরা গরবাখানার পরিচালনায় নারীদের সম্পৃক্ত করতে পারিনি। গ্রামে নারীর দুর্বল ক্ষমতায়ন ও ধর্মীয় গোঁড়ামির কারণে আমাদের নানান চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হচ্ছে। সরকারকেই উদ্যোগ নিয়ে নারীদের উপযুক্ত কাজের পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। ভবিষ্যতে গ্রামের নারীদের তৈরি নকশিকাঁথা ও বিভিন্ন কুটিরশিল্প বাজারজাত করে নারীদের স্বাবলম্বী করার পরিকল্পনা আছে আমাদের।’

গত ২৭ জানুয়ারি গরবাখানা পরিদর্শন করেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা সুলতানা কামাল। লোহাগাড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. ইনামুল হাছান প্রথম আলোকে বলেন, ‘গরবাখানা খুবই ভালো একটি উদ্যোগ। এটি পিছিয়ে পড়া নারীদের এগিয়ে যেতে অনুপ্রেরণা দেবে। আমরা গরবাখানা পরিদর্শন করব। নারীদের জন্য কাজ করা সরকারি সংস্থাগুলো থেকে তাদের সহযোগিতা করার চেষ্টা করব।’

চট্টগ্রাম জেলা পরিষদের সদস্য (সাতকানিয়া, লোহাগাড়া, বাঁশখালী) সুরাইয়া হক বলেন, ‘সুবিধাবঞ্চিত নারীদের জন্য এমন উদ্যোগের বিকল্প নেই। আমরা এ উদ্যোগকে এগিয়ে নিতে সব ধরনের সহযোগিতা করার চেষ্টা করব।’