আমিনা বেওয়ার জীবন লড়াইয়ের, সুখের সঙ্গে তাঁর হয়নিকো দেখা
কাঠফাটা রোদে গ্রামের মেঠোপথ ধরে হেঁটে যাচ্ছেন একজন বৃদ্ধা। মাথায় ডালি। কাছে গিয়ে দেখা গেল, ডালিভর্তি বাদাম। গ্রাম ঘুরে সেগুলো বিক্রি করছেন তিনি। নাম আমিনা বেওয়া। বয়স ৭০ পেরিয়েছে।
রংপুর সদর উপজেলার মমিনপুর ইউনিয়নের বামনপাড়া গ্রামে গত রোববার দুপুরে আমিনা বেওয়ার সঙ্গে দেখা হয়। বামনপাড়ার পাশে মাস্টারপাড়া গ্রামে তাঁর বাড়ি। দুই গ্রামের দূরত্ব প্রায় আধা কিলোমিটার।
চানাচুর, বাদাম, বুটসহ শিশুদের বিভিন্ন খাবার ফেরি করে সাধারণত পুরুষেরাই বিক্রি করেন। নারী বিক্রেতা দেখা যায় কম। সেই ব্যতিক্রমী একজন আমিনা বেওয়া। কত দিন ধরে এ কাজ করছেন—জানতে চাইলে তিনি বলেন, কমসে কম ২০ বছর তো হবে। তেল, সাবান, লবণ, মসলাসহ নানা জিনিস ফেরি করে বিক্রি করেন। আগে ছেলে ফেরদৌসকে নিয়ে যেতেন। এখন সে ঢাকায় থাকে।
আগে ছেলের সঙ্গে ভারে করে মালামাল নিতেন আমিনা বেওয়া। এখন বয়স হয়েছে, তাই ডালি নেন। ডালিতে বেশি মালপত্র বহন করা সম্ভব হয় না। তাই বিক্রিও কম হয়।
দুপুরের প্রচণ্ড রোদে মাঠে কাজ করছিলেন অনেকে। কেউ ছাতা, কেউ টুপি দিয়ে মাথা ঢেকেছেন। কেউ কেউ গাছের ছায়ায় বসে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। তেমনি এক গাছের ছায়ায় বসে আমিনার সঙ্গে কথা হয়। বৃদ্ধ বয়সে রোদে কেন বের হন—এ প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘চলি ফিরি খাওয়া নাগে।’ অর্থাৎ যত দিন চলতে পারবেন, তত দিন কাজ করে খেতে চান।
আমিনা জানান, বদরগঞ্জ হাট থেকে কারও মাধ্যমে বা নিজেই কাঁচা বাদাম কিনে আনেন। আবার কখনো মনিরপুর মিলেরপাড়ার প্রদীপ কুমারের হোটেল থেকে ২০-৩০ পিস শিঙাড়া এনে বিক্রি করেন।
বামনপাড়ার লিপি বেগমদের উঠানে কয়েকজন নারীর কাছে ৫-১০ টাকার বাদাম বিক্রি করছিলেন তিনি। লিপি বেগম বলেন, ‘এই বয়সেও পরিশ্রম করছেন আমিনা বেওয়া। এমন কর্মঠ নারী গ্রামে আর নেই।’
কথা বলতে বলতে আমিনা নিজের জীবনের নানা দুঃখগাথা বলেন। তাঁর চার ছেলে, তিন মেয়ে। বড় ছেলে কুদ্দুস মিয়া ও ছোট ছেলে এজারুল ৫-৬ বছর আগে মারা গেছেন। এজারুলের মূত্রনালিতে সমস্যা ছিল। কুদ্দুস মারা যান হৃদরোগে। তখন আমিনা ছিলেন ছোট ছেলের চিকিৎসার জন্য রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। বড় ছেলের লাশও দেখতে পারেননি তিনি।
ছোট ছেলে এজারুলের বিয়ে হয়নি, সংসারও হয়নি—এ নিয়ে আফসোস করেন আমিনা। দুই ছেলের মৃত্যুর কয়েক মাস পর তাঁর স্বামী মামুদও মারা যান।
যে বয়সে সন্তানদের সেবা পাওয়ার কথা সে বয়সে আমিনা পরিশ্রম করছেন। কোনো আক্ষেপ আছে কি না জানতে চাইলে উল্টো ছেলেমেয়ের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘ভূই (জমি) দিবার পাও নাই, সংসার দিবার পাও নাই। ফেরদৌস মোবাইল করি কথা কয়। ও ঘর ভাড়া দেয়। পঙ্গু বেটিছইলের (ছেলের স্ত্রী) ব্যারাম (রোগ) হইছে। বাদশা মমিনপুর মিলের পাড়ে চা-পানের দোকান করেন। তায় (সে) চলি ফিরি খায়।’
আমিনা আবার তাঁর দোকানের কথায় ফিরলেন। বহু বছর আগ থেকে দোকান করেন। গ্রামে যখন কারও দোকান হয়নি ওই সময় থেকে তেল, লবণ, সাবান, মসলা, শুঁটকিসহ বিভিন্ন পণ্য বাড়িতে এনে বিক্রি করতেন। এখন পুঁজি নেই, মালামালও নেই। তাই তাঁর বাড়িতে কেউ আসে না এখন আর।
বয়সের কারণে সপ্তাহে দু-তিন দিনের বেশি বের হতে পারেন না আমিনা বেওয়া। মাসে পাঁচ কেজি বাদামও বিক্রি হয় না। তবে প্রদীপের হোটেলের শিঙাড়া নিয়ে গেলে ২০০-২৫০ টাকার মতো বিক্রি হয়।
আমিনা বলেন, ঈদে ভিজিএফের ১০ কেজি চাল পেয়েছেন। এখনো সে চালের ভাত খাচ্ছেন। মাছ-মাংস জোটে না। ১৫ দিন আগে সিলভার কার্প মাছ কিনেছিলেন। রোজার সময় খানিকটা মাংস খাওয়া হয়েছিল। শনিবার সকালে খেয়েছেন আগের রাতের ভাত, দুপুরে খাবেন মুড়ি, রাতে আলু ভর্তা ও ভাত।
কথা শেষে আবার ডালি মাথায় তুলে হাঁটতে শুরু করেন। গন্তব্য আরেক গ্রাম– বামনটারী।
মমিনপুর মিলেরপাড়ে দেখা হলো হোটেল ব্যবসায়ী প্রদীপ কুমারের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘আমিনা অনেক পরিশ্রমী। বয়স হয়ে গেছে, তারপরও বাড়িতে বসে থাকেন না। কিছুদিন আগে রাস্তায় পড়ে গিয়ে পা ভেঙেছিল। দুই মাসের মধ্যেই আবার কাজে বের হয়েছেন।’
আমিনার বাড়িতে গেলে তাঁর নাতনি শারমিন আখতার বলেন, ‘দাদি বলেন, “যত দিন চলতে পারব, তত দিন কাজ করে খাব। চলতে না পারলে একমুঠো ভাত দিলে চলবে।”’