‘এখন কী হবে ওর স্ত্রী-সন্তানের’

মালয়েশিয়ায় তেলের ট্যাংকিতে পড়ে প্রাণ হারানো এনায়েত
ছবি: সংগৃহীত

তিন ভাই ও দুই বোনের মধ্যে সবার ছোট এনায়েত শেখ (৩৩)। পরিবারের ভাগ্যের উন্নয়নে এক যুগ আগে মালয়েশিয়া গিয়েছিলেন তিনি। তিন বছর আগে দেশে এসে বিয়ে করেন। বিয়ের পর ১৭ মাস আগে আবার দেশে এসেছিলেন।

ছয় মাস আগে সন্তানের বাবা হন এনায়েত। তিনিই পছন্দ করে ছেলের নাম রাখেন ‘ওসামা’। সেই ছেলের মুখ দেখা হলো না তাঁর। তিনি চলে গেলেন না ফেরার দেশে।

ঈদুল আজহার সময় দেশে আসার কথা ছিল তাঁর। গত শনিবার বাংলাদেশ সময় সকাল ৯টার দিকে মালয়েশিয়ায় নিজ কর্মস্থলে তেলের ট্যাংকির ভেতর পড়ে তাঁর মৃত্যু হয়।

এনায়েতের বৃদ্ধ মা তছিরন বেগম (৬৬) কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘ছেলেটা আমার বিদেশে গিয়ে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে উপার্জন করে আমাদের মুখে হাসি ফুটিয়েছিল। সর্বশেষ সে ১৭ মাস আগে এসেছিল। বিদেশে থাকতেই ছেলের বাবা হয়। ছেলে হওয়ার পর প্রতিদিন ভিডিও কলে ছেলেকে দেখত আর তাকে বলত, আগামী কোরবানির ঈদে এসে সরাসরি ছেলেকে দেখবে। কিন্তু ছেলেকে দেখার আগেই আমার বাজান চলে গেল। এটা আমরা কীভাবে মেনে নেব। এখন কী হবে ওর স্ত্রী-সন্তানের।’

এনায়েত ফরিদপুরের সালথা উপজেলার সোনাপুর ইউনিয়নের বাংরাইল গ্রামের বাসিন্দা মৃত হামেদ শেখের ছেলে। তিন বছর আগে দেশে এসে পরিবারের পছন্দে বিয়ে করেন তিনি। স্ত্রী লাইজু খাতুন সালথার ইউসুফ দিয়া গ্রামের মেয়ে।

ঈদুর আজহায় এনায়েত আসবেন দেশে, দেখা হবে ছেলের সঙ্গে, এ আনন্দে মশগুল ছিলেন পরিবারের সদস্যরা। শনিবার সকাল সাতটার দিকে কাজে বের হওয়ার আগে মালয়েশিয়া থেকে ইমোতে ভিডিও কলে কথা বলেন এনায়েত। কথা হয় মা ও স্ত্রীর সঙ্গে। স্ত্রী কোলে নিয়ে ছেলেকে দেখান। এনায়েত স্ত্রীকে বলেন, ‘আর তো মাত্র কয়েক দিন। কোরবানির ঈদের আগেই আসব, এসে সরাসরি ছেলেকে দেখবে, ওকে কোলে নিয়ে ঘুড়ে বেড়াব, মজা করব।’ মাত্র দুই ঘণ্টা পর তাঁর বাংলাদেশি সহকর্মীরা ফোন করে জানান মর্মান্তিক এ খবর। সহকর্মীরা জানান, এনায়েত তেলের ট্যাংকি পরিষ্কার করার সময় ট্যাংকির ভেতরে পড়ে যায়। পরে গুরুতর আহত অবস্থায় তাঁকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসকেরা মৃত ঘোষণা করেন।

পরিবারের ছোট ছেলের এ মৃত্যুর খবরে পুরো পরিবারে শোকের ছায়া নেমে এসেছে। পরিবারের আহাজারিতে এলাকার পরিবেশ ভারী হয়ে উঠেছে।

এনায়েতের বড় ভাই শাহাদত শেখ বলেন, ১২ বছর আগে মালয়েশিয়ায় যায় এনায়েত। মালোশিয়ার জহুরবারো এলাকায় একটি পেট্রলপাম্পে কর্মী হিসেবে কাজ করতেন। প্রতিদিনের মতো শনিবার সকাল সাতটার দিকে ফোনের মাধ্যমে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা হয় তাঁর। এটিই পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে তাঁর শেষ কথা।

শাহাদাত আরও বলেন, এনায়েতের সঙ্গে একই কোম্পানিতে তাঁর এক আত্মীয় হাসান শেখ (২৮) কাজ করেন। হাসান জানিয়েছেন, দেশে লাশ পাঠানোর ব্যবস্থা করবে কোম্পানিই। ঢাকার শাহজালাল বিমানবন্দর থেকে তাঁদের লাশটি গ্রহণ করতে হবে। অবশ্য এর জন্য ৭ থেকে ১০ দিন অপেক্ষা করতে হবে।

স্থানীয় সোনাপুর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান খায়রুজ্জামান বলেন, এনায়েত এলাকায় একজন ভালো মানুষ হিসেবে পরিচিত। গ্রাম্য কোনো দলাদলির মধ্যে এই পরিবারের সদস্যরা থাকতেন না। তাঁরা কোনো মামলার আসামিও নন, আবার সাক্ষীও নন। মালয়েশিয়ায় থেকে উপার্জন করে গ্রামে তানজিমুল উম্মা মহিলা মাদ্রাসা ও নূরানী একাডেমি নামে একটি মাদ্রাসাও প্রতিষ্ঠা করেছেন তিনি। ওই মাদ্রাসায় বাংলা, অঙ্ক, ইংরেজি, আরবি সব বিষয়েই পড়ানো হয়। চার নারীসহ শিক্ষক আছেন ছয়জন, শিক্ষার্থী আছে ৮৪ জন।

ইউপি চেয়ারম্যান খায়রুজ্জামান আরও বলেন, গ্রামের সবাই এনায়েতকে আলাদা চোখে দেখতেন, ভালোবাসতেন। তাঁর এমন অকালমৃত্যুর খবর পরিবারের সদস্যদের মতো গ্রামের লোকজনও মেনে নিতে পারছেন না।

সালথা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. আক্তার হোসেন বলেন, এনায়েতের লাশ দেশে আনার জন্য যেসব প্রক্রিয়া আছে, তা অনুসরণ করে নিয়ে আসার উদ্যোগে নেবেন তিনি।