লঞ্চের যাত্রী অর্ধেকে নেমেছে, দুর্মূল্যের বাজারে হকারদের দুর্দশা

লঞ্চে যাত্রী কমে যাওয়ায় লঞ্চের হকাররা বিপাকে পড়েছেন। গতকাল দুপুরে দৌলতদিয়া লঞ্চঘাটে
ছবি: প্রথম আলো

রাজবাড়ীর দৌলতদিয়া ও মানিকগঞ্জের পাটুরিয়া নৌপথে চলাচলরত লঞ্চে তিলের খাজা বিক্রি করেন মো. মিজান মোল্লা (৬৫)। পদ্মা সেতু চালুর পর থেকে এই রুটে লঞ্চে যাত্রী কমে গেছে। এতে মিজানের আয়ও কমে গেছে। এর মধ্যে বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় সব জিনিসপত্রের দাম চড়া। এমন পরিস্থিতিতে সংসার চালাতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছেন মিজান।

একসময় নিজের বাড়ি ছিল। চার বিঘা জমিও ছিল। তবে চার বছর আগে নদীভাঙনে সব হারিয়েছেন লঞ্চের হকার মিজান মোল্লা। মিজানের বাড়ি ছিল রাজবাড়ীর গোয়ালন্দ উপজেলার দৌলতদিয়ার ঢল্লা পাড়ায়। নদীতে বসতভিটা বিলীন হয়ে গেলে তিনি আশ্রয় নেন গোয়ালন্দ শহরের বিন্দু পাড়ায়। সেখানে বড় মেয়ের বাড়িতে স্ত্রীকে নিয়ে থাকেন তিনি। বর্তমানে সেখানে স্ত্রী, মেয়ে, জামাই ও দুই নাতিকে নিয়ে আছেন।

গতকাল বৃহস্পতিবার সকালে দৌলতদিয়া লঞ্চঘাটে মিজানের মতো আরও কয়েকজন হকারের সঙ্গে কথা হয়। তাঁদের মধ্যে কেউ ঝালমুড়ি, কেউ কলা বিক্রি করেন। আবার কেউ তিলের খাজা কিংবা কেউ বই বিক্রি করেন। তাঁরা বলেন, পদ্মা সেতু চালুর পর দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া নৌপথে যাত্রীসংখ্যা প্রায় অর্ধেকে নেমে এসেছে। আগের মতো বেচাকেনা না থাকায় তাঁরা হতাশ হয়ে পড়েছেন। ইতিমধ্যেই অনেক হকার পেশা পরিবর্তন করে অন্য পেশায় গিয়ে টিকে থাকার চেষ্টা করছেন।

মিজান মোল্লা বলেন, আগে প্রতিদিন ৭০০ টাকা থেকে ১ হাজার টাকা পর্যন্ত রোজগার হতো। খরচ বাদ দিয়ে দিন শেষে বাজার করতেন। চাল-ডাল কেনার পরও তাঁর হাতে ১০০ থেকে ২০০ টাকা থাকত। কিন্তু এখন সারা দিনে ২০০ থেকে ২৫০ টাকার মতো রোজগার হয়। অথচ ৬ সদস্যের সংসারে প্রতিদিন খরচ লাগে ৩০০ থেকে ৪০০ টাকার মতো। সঙ্গে অন্যান্য খরচ তো আছেই। পদ্মা সেতু চালুর পর থেকে লঞ্চে যাত্রীসংখ্যা অর্ধেকে নেমে গেছে।

বেচাকেনা না থাকায় অনেক হকার পেশা পরিবর্তনের কথা ভাবছেন
ছবি: প্রথম আলো

এদিকে জ্বালানি তেলসহ নিত্যপণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় মিজান দিশেহারা হয়ে পড়েছেন। তিনি বলেন, ‘অভাবের মধ্যে মেয়ে-জামাই সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছে। এখন আমরা বাড়তি যোগ হয়েছি। এখন না পারছি নিজেরা কিছু করতে, না পারছি চলে আসতে। কোনোভাবেই টিকতে পারছি না রে বাবা।’

সাইদুল শেখ (৬০) লঞ্চঘাটে ঝালমুড়ি বিক্রি করেন। তিনিও বছর তিনেক আগে নদীভাঙনে সব হারিয়েছেন। এখন দৌলতদিয়ার ঢল্লা পাড়া থেকে প্রায় তিন কিলোমিটার দূরে আক্কাছ আলী হাইস্কুলের কাছে চার কাঠা জমি বাৎসরকি লিজ নিয়ে বাস করছেন। তাঁর সংসারে স্ত্রী, এক ছেলে ও এক মেয়ে রয়েছে।

সাইদুল শেখ বলেন, ‘আগে প্রতিদিন ৭০০-৮০০ টাকা রোজগার করতাম। সংসার খরচ বাদে কিছু টাকা জমা থাকত। বাড়ি ফিরলে ছেলেমেয়ের হাতে কিছু খাবার দিতে পারতাম। এখন তো লঞ্চে লোকজন নাই। এর ওপর জিনিসপত্রের দাম অনেক বেড়ে গেছে। প্রতিদিন সন্ধ্যায় যখন বাড়ি ফিরি তখন ছেলেমেয়ে দৌড়ে কাছে আসে। কিন্তু কিছুই দিতে পারি না। এক পোয়া কাঁচা মরিচের দাম ৬০ টাকা। অথচ ইনকাম নাই। আমরা এখন কার কাছে যাব?’

আলাপের মধ্যে আরও দুই হকার শহিদুল শেখ ও ইউসুফ ব্যাপারী এসে পাশে দাঁড়ালেন। তাঁরা বলেন, সম্প্রতি অনেক হকার এই লঞ্চঘাট ছেড়ো গেছেন। কয়েক মাস আগেও এই ঘাটে প্রায় ৩০ জন হকার ছিলেন। তবে বেচাকেনা কমে যাওয়ায় বর্তমানে ঘাটে ১৯ জন হকার আছেন।

আরিচা লঞ্চমালিক সমিতির দৌলতদিয়া ঘাট তত্ত্বাবধায়ক নুরুল আনোয়ার বলেন, মালিক সমিতির ৩৬টি লঞ্চের মধ্যে বর্তমানে দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া রুটে ১৭টি চলাচল করছে। এখন মানুষ পদ্মা সেতু দিয়ে যাতায়াত করছে। লঞ্চে আর আগের মতো যাত্রী নেই। তাই লঞ্চে হকারদের আনাগোনাও কম। যাত্রী কম থাকায় এসব হকাররা খুব কষ্টে দিন পার করছেন।