এনবিআর কর্মকর্তাদের ‘শাটডাউনে’ স্থলবন্দরগুলোতে স্থবিরতা, পণ্যবাহী গাড়ির জট

এনবিআর কর্মকর্তাদের ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচির কারণে তৈরি হয়েছে পণ্যবাহী গাড়ির জট। আজ রোববার সকাল ১০টার দিকে সাতক্ষীরার ভোমরা স্থলবন্দরেছবি: প্রথম আলো

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কর্মকর্তাদের ‘শাটডাউন’ কর্মসূচির কারণে দুই দিন ধরে দেশের বিভিন্ন স্থলবন্দরে আমদানি-রপ্তানির শুল্ক-কর আদায় কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। এতে বিভিন্ন বন্দরে পণ্য নিয়ে আসা গাড়ির জট তৈরি হয়েছে। স্থবির হয়ে পড়েছে স্থলবন্দরগুলোর সামগ্রিক কার্যক্রম।

এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদের ডাকা এ কর্মসূচির কারণে গতকাল শনিবার থেকে ঢাকার এনবিআর ভবন থেকে শুরু করে সংস্থাটি চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর, স্থলবন্দর, ঢাকা কাস্টম হাউসসহ দেশের সব কাস্টম হাউস ও শুল্ক স্টেশনের রাজস্ব কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। তবে স্থলবন্দরগুলোতে দুই দেশের যাত্রী পারাপারের কার্যক্রম স্বাভাবিক রয়েছে।

দুই দিন কার্যক্রম বন্ধ থাকায় যশোরের বেনাপোল স্থলবন্দরে অন্তত ৮০০ ট্রাক পণ্য আমদানি ও ২০০ ট্রাক পণ্য রপ্তানি হয়নি। ফলে দুই পারে পণ্যবাহী ট্রাকের জট সৃষ্টি হয়েছে বলে বন্দর সূত্রে জানা গেছে। শনিবার সকাল থেকে আজ রোববার সন্ধ্যা পর্যন্ত বেনাপোল কাস্টম হাউসের অধিকাংশ কর্মকর্তা চেয়ারে বসেননি।

এ বিষয়ে বেনাপোল ক্লিলিয়ারিং অ্যান্ড ফরোয়ার্ডিং (সিঅ্যান্ডএফ) এজেন্ট স্টাফ অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক সাজেদুর রহমান বলেন, ‘ভারতের পেট্রাপোলে পণ্যবাহী অন্তত ৮০০ ট্রাক বাংলাদেশে প্রবেশের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে রয়েছে। অনির্দিষ্টকালের এ কর্মসূচিতে ব্যবসায়ীরা বিপাকে পড়েছেন। পণ্যের ডেলিভারি হচ্ছে না। এতে শিল্পসহ পচনশীল পণ্যের সরবরাহ বন্ধ হয়ে গেছে।’

বেনাপোল বন্দর ব্যবহারকারী মতিয়ার রহমান বলেন, ‘কাস্টমস কর্মকর্তাদের শাটডাউন কর্মসূচিতে দেশে পণ্যের সংকট মোকাবিলা করা কঠিন হবে।’

আরও পড়ুন

বাংলাবান্ধা স্থলবন্দরে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শনিবার সকাল থেকে শুল্ক স্টেশনের কর্মকর্তারা কোনো দাপ্তরিক কার্যক্রম চালাচ্ছেন না। এতে শনিবার সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ভুটান থেকে আমদানি করা পাথর নিয়ে ১৫১টি ট্রাক বন্দরে প্রবেশ করলেও এসব পণ্যের শুল্ক-কর আদায়সহ ছাড়পত্র দেওয়া হয়নি। আজ এই বন্দরে আমদানি পণ্য নিয়ে কোনো গাড়ি প্রবেশ করেনি। তবে গতকাল আমদানি করা ১৫১টি পণ্যবাহী গাড়ি খালাসের অপেক্ষায় ইয়ার্ডে পড়ে আছে। এসব গাড়ি ছাড় না পাওয়ায় ভুটান থেকে পণ্য নিয়ে গাড়িচালকেরাও বিপাকে পড়েছেন। এ ছাড়া বন্দরে পণ্য লোড-আনলোড (ওঠানামা) না হওয়ায় কর্মহীন হয়ে পড়েছেন বন্দরসংশ্লিষ্ট শ্রমিকেরা।

বাংলাবান্ধা স্থলবন্দর সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর আলম বলেন, কাস্টমস কর্মকর্তারা আন্দোলনের কারণে আমদানি করা পণ্যের শুল্ক আদায় করেননি এবং ছাড়পত্রও দেননি। এ জন্য এসব পণ্য নিয়ে আসা গাড়িগুলো খালাসের অপেক্ষায় আছে। এতে বন্দরের শ্রমিক ও আমদানিকারকদের পাশাপাশি সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টরাও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।

বাংলাবান্ধা স্থলবন্দর লিমিটেডের ইনচার্জ আবুল কালাম আজাদ মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, শনিবার ভুটান থেকে পাথর নিয়ে আসা ১৫১টি ট্রাক ছাড়পত্র না পাওয়ায় খালাসের অপেক্ষায় ইয়ার্ডে আছে। বন্দরের স্থবিরতার পাশাপাশি সরকারের রাজস্ব আদায় হচ্ছে না।

আখাউড়া স্থলবন্দর শুল্ক স্টেশন সূত্রে জানা গেছে, কমপ্লিট শাটডাউন কর্মসূচির কারণে আমদানি-রপ্তানির জন্য বিল অব এক্সপোর্ট ও বিল অব এন্ট্রি করতে পারছেন না ব্যবসায়ীরা। যদিও আগাম বিল অব এক্সপোর্ট করে রাখার কারণে শনিবার বন্দর দিয়ে তিন গাড়িতে ৩০ টন আটা এবং ২৩ গাড়িতে ১১৫ টন মাছ আগরতলায় পাঠানো হয়েছে।

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া স্থলবন্দর। আজ রোববার দুপুরে
ছবি: ছবি প্রথম আলো

আখাউড়া স্থলবন্দরের ব্যবসায়ী নেসার আহমেদ ভূঁইয়া জানান, বন্দরে একপ্রকার অচলাবস্থা চলছে। ব্যবসায়িক কার্যক্রম নেই বললেই চলে। কখন সমস্যার সমাধান হয়, সেটা জানা নেই।

আরও পড়ুন

আখাউড়া স্থল শুল্ক স্টেশনের রাজস্ব কর্মকর্তা মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম জানান, যেহেতু বন্দর দিয়ে পণ্য আমদানি অনিয়মিত সে জন্য আমদানি বাণিজ্যে কোনো প্রভাব পড়ছে না। এ ছাড়া রোববার ভারতে সাপ্তাহিক ছুটির দিন হওয়ায় এদিন বন্দর দিয়ে খুব বেশি পণ্য রপ্তানিও হয় না। তাই বন্দরে রপ্তানির কোনো পণ্যবাহী ট্রাক আসেনি।

একই অবস্থা সাতক্ষীরা ভোমরা স্থলবন্দরেও। রোববার বেলা ১১টায় ভোমরা কাস্টমসে গিয়ে কোনো কর্মকর্তাকে পাওয়া যায়নি। বন্দর এলাকা ফাঁকা। লোকজন নেই বললেই চলে। তবে পাসপোর্ট যাত্রীদের ভারতে যাতায়াতের জন্য খোলা রয়েছে ভোমরা কাস্টমসের একটি অংশ ও ইমিগ্রেশন অফিস।

ভোমরা বন্দর হ্যান্ডলিং শ্রমিক ইউনিয়নের সাবেক কোষাধ্যক্ষ আবিদুর রহমান বলেন, বর্তমানে চারটি শ্রমিক ইউনিয়নের নিবন্ধিত শ্রমিকের সংখ্যা ৩ হাজার ২০০। এ ছাড়া অনিবন্ধিত শ্রমিকের সংখ্যা রয়েছেন আরও এক হাজার। আমদানি-রপ্তানি বন্ধ থাকায় শ্রমিকেরা সবচেয়ে বেশি অসুবিধায় পড়েছেন। দিন আনা দিন খাওয়া শ্রমিকদের কষ্টের সীমা নেই।

ভোমরা বন্দরের সুপারিনটেনডেন্ট (প্রশাসন) মো. মিজানুর রহমান মুঠোফোনে বলেন, কমপ্লিট শাটডাউনে শনিবার থেকে ভোমরা বন্দরের সব কিছু বন্ধ রয়েছে। এনবিআরের চেয়ারম্যানের অপসারণসহ অন্যান্য দাবি না মানা পর্যন্ত তাঁদের কর্মসূচি চলবে।

মোংলায় ব্যবসায়ীদের মানববন্ধন

মোংলা কাস্টম হাউসের ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচির বিরোধিতা করে মানববন্ধন করেছেন স্থানীয় ব্যবসায়ী ও শ্রমিকেরা। রোববার দুপুরে মোংলা উপজেলা চত্বরের পৌর মার্কেট চত্বরে এই মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হয়। এ সময় অন্যদের মধ্যে বক্তব্য দেন ইপিজেড ব্যবসায়ী মো. নাসির তালুকদার, বন্দর ব্যবহারকারী মাহবুবুর রহমান, এমরান হোসেন ও শ্রমিকনেতা মো. আলাউদ্দিন। শাটডাউন কর্মসূচি প্রত্যাহার না করলে মোংলা কাস্টম হাউস ঘেরাওসহ কঠোর কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে বলে মানববন্ধন থেকে হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক ব্যবসায়ী বলেন, দুই দিন ধরে তিনি তাঁর আমদানি করা পণ্য ছাড়ানোর জন্য প্রয়োজনীয় স্বাক্ষর পাচ্ছেন না। এতে একদিকে তাঁর উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে, অন্যদিকে বন্দরে খরচ বাড়ছে। এ ধরনের পরিবেশ মোটেই ব্যবসার জন্য উপযোগী নয়।

তবে মোংলা বন্দর কর্তৃপক্ষের উপপরিচালক (বোর্ড ও জনসংযোগ বিভাগ) মো. মাকরুজ্জামানের দাবি, বন্দরের কার্যক্রম স্বাভাবিক রয়েছে। রোববারও বন্দর জেটিতে আমদানি করা চিটাগুড় নিয়ে একটি জাহাজ অবস্থান করছে। সাত হাজার মেট্রিক টন চিটাগুড় নিয়ে আসা জাহাজটি থেকে পাঁচ হাজার টন আগেই খালাস করা হয়েছে। দুই হাজার টন খালাসের কার্যক্রম আজ চলমান রয়েছে।

[প্রতিবেদন তৈরিতে তথ্য দিয়েছেন, নিজস্ব প্রতিবেদক, সাতক্ষীরাব্রাহ্মণবাড়িয়া, প্রতিনিধি, পঞ্চগড়বাগেরহাট এবং যশোর অফিস]