মা কারাগারে, বাবা সাগরে, মুক্তি পেয়েও ঠাঁই হলো না পরিবারে

চট্টগ্রাম আদালত ভবনফাইল ছবি

চট্টগ্রামে অপহরণ মামলায় আইনের সংস্পর্শে নেওয়া সাত বছরের শিশুটি আদালতের নির্দেশে মুক্তি পেলেও পরিবারের কাছে যেতে পারছে না। মা চার দিন ধরে রয়েছেন কারাগারে। বাবা গেছেন সাগরে মাছ ধরতে। এই অবস্থায় শিশুটির ঠাঁই হচ্ছে চট্টগ্রামের হাটহাজারীর সমন্বিত শিশু পুনর্বাসন কেন্দ্রে। আজ সোমবার চট্টগ্রাম মহানগর দায়রা জজ মো. হাসানুল ইসলাম শিশুটিকে সেখানে রাখার নির্দেশ দেন।

বিচারক আদেশে উল্লেখ করেন, মুক্তির আদেশপ্রাপ্ত সাত বছর বয়সী শিশুটির বাবা জীবিকা নির্বাহের জন্য বঙ্গোপসাগরে মাছ শিকারে ব্যস্ত রয়েছেন। মা কারাগারে। শিশুটির আর কোনো অভিভাবক না থাকায় চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের প্রবেশন কর্মকর্তার তত্ত্বাবধানে সমন্বিত শিশু পুনর্বাসন কেন্দ্রে রাখার অনুমতি দেওয়া হলো।

‘চট্টগ্রামে ৭ বছরের শিশুর নামে মামলা নিল পুলিশ, তিন দিনেও মেলেনি মুক্তি’ শিরোনামে গতকাল রোববার প্রথম আলো অনলাইনে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। আজ সোমবার দিনভর আদালতপাড়া ও নগর পুলিশে আলোচিত হয় বিষয়টি।

নগর পুলিশ কমিশনারের নির্দেশে সাত বছরের শিশুর বিরুদ্ধে মামলা হওয়ার বিষয়ে তদন্ত করে প্রতিবেদন দিয়েছে পুলিশ। এর ভিত্তিতে বদলি করা হয়েছে চট্টগ্রাম মহানগর দায়রা জজ আদালতের বেঞ্চ সহকারী (পেশকার) মনির হোসেন সরকার ও নারী ও শিশু আদালতের জিআরও মো. শহীদকে।

চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের প্রবেশন কর্মকর্তা মনজুর মোরশেদ আজ বিকেলে প্রথম আলোকে বলেন, আদালতের নির্দেশে শিশুটিকে গাজীপুরের টঙ্গী শিশু উন্নয়ন কেন্দ্র থেকে মুক্তি দেওয়া হয়েছে। তাকে চট্টগ্রামে নিয়ে আসা হচ্ছে। রাতে পৌঁছানোর পর হাটহাজারীর সমন্বিত শিশু পুনর্বাসন কেন্দ্রে রাখা হবে। শিশুটির বাবা মাছ ধরতে সাগরে আর মা কারাগারে আছেন। বাবা আসার পর শিশুটিকে তাঁর জিম্মায় দেওয়া হবে।

জানতে চাইলে শিশুটির বাবা আজ সন্ধ্যায় প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি বঙ্গোপসাগরে মাছ ধরার জাহাজে। চলে আসার চেষ্টা করছি।’

নগর পুলিশের উপকমিশনার (প্রসিকিউশন) জিয়া উদ্দিন আজ প্রথম আলোকে বলেন, সাত বছরের শিশুর বিরুদ্ধে মামলা হওয়া ও তাকে আদালতে আনার বিষয়ে তদন্ত করে পুলিশ কমিশনারের কাছে প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছে। প্রাথমিকভাবে এ ঘটনায় ত্রুটি পাওয়া গেছে।

মামলাটি গ্রহণকারীদের বিরুদ্ধে নগর পুলিশের পক্ষ থেকে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে কি না, জানতে নগর পুলিশ কমিশনার হাসিব আজিজের মুঠোফোনে কল করা হলে তিনি ধরেননি। পরে নগর পুলিশের সহকারী কমিশনার (গণমাধ্যম) আমিনুর রশিদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিষয়টি আমরা যাচাই-বাছাই করছি।’

বাংলাদেশ হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশন বিএইচআরএফের মহাসচিব অ্যাডভোকেট জিয়া হাবীব আহসান প্রথম আলোকে বলেন, ‘ইতিপূর্বেও সাত বছরের এক শিশুর বিরুদ্ধে ধর্ষণে মামলা হয়। এখনকার ঘটনায় সংশ্লিষ্ট যাদের গাফিলতি রয়েছে, সবার বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি ও ভুক্তভোগীকে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার ব্যবস্থা করা উচিত। এটি ভুলে নয়, কাজে অবহেলার কারণে হয়েছে।’

নগরের পাঁচলাইশ থানার পুলিশ গত শুক্রবার চার বছরের এক শিশুকে অপহরণের অভিযোগে সাত বছরের আরেক ছেলে শিশুর বিরুদ্ধে মামলা নেয়। পরে ওই শিশুকে পুলিশ আইনের সংস্পর্শে নেয়। আদালত ওই দিন শিশুটিকে গাজীপুরের টঙ্গীতে শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে (বালক) পাঠিয়ে দেন।

ঘটনার শুরু চলতি বছরের ১৩ এপ্রিল। চট্টগ্রাম নগরের ষোলশহর রেলস্টেশন এলাকায় বসবাসরত আনোয়ারা বেগমের দুই সন্তানের মধ্যে বড় সন্তান অসুস্থ হলে সেদিন চিকিৎসার জন্য চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যান। সঙ্গে নিয়ে যান চার বছরের ছোট সন্তান মো. রামিমকেও। কিন্তু রামিম সেখান থেকে হারিয়ে যায়। এ ঘটনায় পাঁচলাইশ থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করা হয়। অনেক খোঁজাখুঁজির পরও রামিমকে না পেয়ে ঘটনার সাত মাস পর শুক্রবার পাঁচলাইশ থানায় অপহরণ মামলা করেন তার মা আনোয়ারা বেগম।

এ ঘটনায় সাত বছরের শিশু ও তার মায়ের বিরুদ্ধে মামলা হয়। মামলার এজাহারে বলা হয়, বাদী জানতে পারেন, তাঁর ছেলেকে হাসপাতালের বারান্দা থেকে সাত বছরের ওই শিশু ও তার মা খেলার কথা বলে অপহরণ করে নিয়ে যান। মামলা হওয়ার পর ওই দিনই পাঁচলাইশ থানার উপপরিদর্শক (এসআই) এনামুল হক ষোলশহর এলাকা থেকে সাত বছরের শিশুর মাকে গ্রেপ্তার করেন। আইনের সংস্পর্শে নেওয়া হয় শিশুটিকেও।

জানতে চাইলে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-৭ চট্টগ্রামের সরকারি কৌঁসুলি (পিপি) শফিউল মোরশেদ প্রথম আলোকে বলেন, শিশু আইন ও দণ্ডবিধিতে ৯ বছরের কম বয়সী কোনো শিশুর বিরুদ্ধে মামলা নেওয়া, গ্রেপ্তার কিংবা আটকের সুযোগ নেই।