বালু তোলা বন্ধ, প্রাণ ফিরছে ফেনী নদীর
নদীর বিশাল পাড়জুড়ে বিকট শব্দ তুলে দিনরাত চলত খননযন্ত্র। পাড়ের জমি ও তলদেশ কেটে তুলে আনা হতো বালু। বালু পরিবহনের জন্য বড় বড় বাল্কহেডের চলাচলে ব্যস্ত থাকত নদীপথ। এসব কর্মকাণ্ডের কারণে বিস্তীর্ণ অঞ্চলে ভাঙন দেখা দিয়েছিল। অবৈধ বালু উত্তোলনে এবড়োখেবড়ো হয়ে পড়েছিল নদীর দুই পাড়। কোথাও কোথাও ভাঙনে বিলীন হয়েছে কৃষকের ফসলি জমি। অতিরিক্ত বালু উত্তোলনে নদীর ঘোলা পানিতে হুমকিতে পড়েছিল অনেক প্রজাতির মাছ। প্রায় বন্ধ হয়ে গিয়েছিল জলজ পাখিদের আনাগোনা।
চট্টগ্রামের মিরসরাই অংশে ফেনী নদীর এমন চেহারা ছিল সাত মাস আগেও। তবে এখন সে দৃশ্য বদলে গেছে। বালু উত্তোলন না হওয়ায় বন্ধ হয়েছে বাল্কহেডের চলাচল। ফিরতে শুরু করেছে নানা প্রজাতির মাছ আর পাখি। নদীর দুই তীরে ভাঙনও বন্ধ হয়েছে। সবুজে ঘেরা দুই তীর আর মাঝ দিয়ে বয়ে চলা নদীর এই চেহারা বহুদিন পর দেখলেন স্থানীয় কৃষক, জেলে ও দুই পারের বাসিন্দারা। সব মিলিয়ে আবারও আগের রূপ ফিরে পাচ্ছে ফেনী নদী। সরকারিভাবে এবার বালুমহাল ইজারা না দেওয়ায় এখন নদীতে বন্ধ আছে সব ধরনের বালু উত্তোলন। এতেই অনেকটা বিপর্যয় কাটিয়ে উঠেছে সীমান্তবর্তী এই নদী।
মানুষের জীবন-জীবিকা রক্ষা আর নদীকে অক্ষত রাখতে বাধ্য হয়ে জেলা প্রশাসন চলতি সনে এ নদীতে বালুমহাল ইজারা দেওয়া বন্ধ করেছে। এর পর থেকে নদীটি সব দিক দিয়ে স্বাভাবিক হতে শুরু করেছে।
সরকারি নিয়ম অনুযায়ী, বাংলা সনের চৈত্র-বৈশাখ মাসে বালুমহালের ইজারা দেওয়া হয়। এবার ইজারা না দেওয়ায় চৈত্র-বৈশাখ অর্থাৎ এপ্রিল মাসের পর থেকে চলতি নভেম্বর পর্যন্ত নদীতে বালু তোলা বন্ধ আছে। একইভাবে ভাঙন রোধে এবার নদীর ফেনী অংশেও বালু তোলা বন্ধ রাখা হয়েছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে উৎপন্ন হওয়া ফেনী নদী বাংলাদেশের ফেনী, খাগড়াছড়ি ও চট্টগ্রাম জেলার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। ভাটিতে চট্টগ্রামের মিরসরাই ও ফেনী জেলার সোনাগাজী উপজেলার পাশ ঘেঁষে বঙ্গোপসাগরের সন্দীপ চ্যানেলে পড়েছে। ১৫৩ কিলোমিটার দীর্ঘ ও ১৫৯ মিটার প্রশস্ত ফেনী নদী হরেক রকম মাছের প্রজনন ক্ষেত্র। এ ছাড়া বর্ষায় পানি নিষ্কাশন ও সারা বছর কৃষিকাজে পানির জোগান দেয় এই নদী।
ফিরছে মাছ, পাখি
সম্প্রতি নদীটির মিরসরাই উপজেলায় উজানে করেরহাট ইউনিয়নের অলিনগর গ্রামের আমলি ঘাট থেকে ভাটিতে মুহুরী প্রকল্প এলাকা পর্যন্ত ঘুরে দেখা যায়, নদীতে বালু উত্তোলন বন্ধ রয়েছে। শান্ত নদীর কোথাও শোনা যায়নি খননযন্ত্রের শব্দ। দেখা যায়নি, বালুবাহী বাল্কহেডের দৌরাত্ম্য। নদীর বিভিন্ন অংশে মাছের উপস্থিতি বেড়েছে বলে জেলেরা জানালেন। স্বচ্ছ জলে দাপাদাপি করতে দেখা গেছে ডাহুক ও পানকৌড়ি পাখিদের।
মিরসরাই উপজেলা প্রশাসন সূত্র জানায়, ফেনী নদীর ভাটিতে শেষভাগে মুহুরী প্রকল্পের আওতায় স্লুইসগেট থাকায় বর্ষায় উজানের পাহাড়ি এলাকা থেকে নেমে আসা পলি ও বালুর বড় একটি অংশই নদীতে থেকে যায়। ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে ফেনী নদীতে পলি আর বালু জমে বেশি। তাই যাচাই-বাছাই করে নদীর নাব্যতা ঠিক রাখতে নদীর কয়েকটি অংশে বালুমহাল ইজারা দেওয়া হতো। কিন্তু কয়েক বছর ধরে ফেনী নদীর মিরসরাই অংশে বালু উত্তোলনে নৈরাজ্য সৃষ্টি হয়। এ সময় ইজারা এলাকা বাদ দিয়ে নদীর বিভিন্ন অংশজুড়ে অবৈধ বালু উত্তোলনের কারণে পাড়ের কৃষিজমি বিলীন হওয়াসহ নদীর প্রাণবৈচিত্র্য পুরোপুরি ধ্বংস হওয়ার উপক্রম হয়। এমন পরিস্থিতিতে নদী রক্ষায় এই মৌসুমে বালুমহাল ইজারা দেওয়া হয়নি।
করেরহাট ইউনিয়নের কৃষক আফতাব উদ্দিন বলেন, ফেনী নদীতে বালুমহাল ইজারা বন্ধ হওয়ার পর প্রশাসনের হস্তক্ষেপে এখন বালু উত্তোলন বন্ধ আছে। তবু রাতের আঁধারে একটি চক্র শ্যালো মেশিন বসিয়ে বালু তোলার চেষ্টা করে। আগে নদীর দুই পাড়ে তাকালে মনে হতো যুদ্ধবিধ্বস্ত এলাকা। পেশিশক্তির জোরে আইন অমান্য করে একদল লোক অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করে নদীর মানচিত্র বদলে দিয়েছে। এখন অনেক দিন ধরে বালু উত্তোলন বন্ধ থাকায় নদী তার স্বাভাবিক রূপ ফিরে পাচ্ছে। পানি স্বচ্ছ হয়েছে, মাছের আনাগোনা দেখা যাচ্ছে, পাখপাখালির ওড়াউড়ি বাড়ছে।
ফেনী নদীর ফেনী অংশে ভাঙন তীব্রতর হওয়ায় দুই বছর আগে সরকার বালুমহালের ইজারা দেওয়া বন্ধ করেছে। ১৪৩০ থেকে চলতি ১৪৩২ বঙ্গাব্দ পর্যন্ত সরকার বালুমহালের ইজারা দেয়নি। আগেরগুলোও বাতিল করা হয়েছে। ইতিমধ্যে অবৈধভাবে বালু উত্তোলনকারীদের বিরুদ্ধে একাধিকবার অভিযান পরিচালনা করে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের গ্রেপ্তার, মালামাল জব্দ ও মামলা দায়ের করা হয়েছে।
মিরসরাই উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সোমাইয়া আক্তার এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘আমি দায়িত্ব নেওয়ার পর ফেনী নদীর যে দৃশ্য দেখেছি, সেটি রীতিমতো ভয়াবহ। তখন নদীর ক্ষতবিক্ষত পাড়, পাড় ভেঙে বিলীন হচ্ছে কৃষকের জমি, মানুষের বসতঘর। এসব রুখতে আমরা সেখানে দফায় দফায় অভিযান করেছি। মানুষের জীবন-জীবিকা রক্ষা আর নদীকে অক্ষত রাখতে বাধ্য হয়ে জেলা প্রশাসন চলতি সনে এ নদীতে বালুমহাল ইজারা দেওয়া বন্ধ করেছে। এর পর থেকে নদীটি সব দিক দিয়ে স্বাভাবিক হতে শুরু করেছে।’
তবে দীর্ঘ সময় নদী থেকে বালু উত্তোলন বন্ধ রাখলে নাব্যতা সংকট তৈরি হয়ে বর্ষায় বন্যার আশঙ্কা থাকে। তাই সামনের বছরগুলোতে বালুমহাল ইজারা দিলেও নদীর স্বাস্থ্য রক্ষার বিষয়টি সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে সব দিক পর্যবেক্ষণ করে তা ভাবা হবে বলে জানান ইউএনও সোমাইয়া আক্তার।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) চট্টগ্রাম বিভাগীয় সমন্বয়কারী মনিরা পারভীন প্রথম আলোকে বলেন, ‘অস্বাভাবিকভাবে বালু উত্তোলনের কারণে নষ্ট হচ্ছিল ফেনী নদীর পারের কৃষকদের জমি। ধ্বংস হয়ে যাচ্ছিল নদীর জীববৈচিত্র্য। পরিবেশ সচেতন মানুষদের প্রতিবাদ ও প্রশাসনের তৎপরতায় এখন ফেনী নদীতে বালু উত্তোলন বন্ধ আছে। স্থানীয় সহযোগীদের কাছ থেকে জানতে পেরেছি, বালু উত্তোলন বন্ধের পর থেকে নদীটি প্রাণ ফিরে পাচ্ছে। জীববৈচিত্র্য স্বাভাবিক হচ্ছে।’
ফেনী অংশেও বন্ধ বালু তোলা
ফেনী নদীর ফেনী অংশে ভাঙন তীব্রতর হওয়ায় দুই বছর আগে সরকার বালুমহালের ইজারা দেওয়া বন্ধ করেছে। ১৪৩০ থেকে চলতি ১৪৩২ বঙ্গাব্দ পর্যন্ত সরকার বালুমহালের ইজারা দেয়নি। আগেরগুলোও বাতিল করা হয়েছে। ইতিমধ্যে অবৈধভাবে বালু উত্তোলনকারীদের বিরুদ্ধে একাধিকবার অভিযান পরিচালনা করে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের গ্রেপ্তার, মালামাল জব্দ ও মামলা দায়ের করা হয়েছে।
বালু ইজারা বন্ধ প্রসঙ্গে ফেনীর অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) ফাহমিদা হক বলেন, বাংলা সন ১৪৩০ থেকে ১৪৩২ পর্যন্ত ফেনী নদীর শুভপুর অংশে বালু উত্তোলনের কোনো ইজারা দেওয়া হয়নি। যদি কেউ অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করে, সে ক্ষেত্রে অভিযান পরিচালনা করে জেল–জরিমানা করা হচ্ছে।
ফাহমিদা হক আরও বলেন, নদীতে যদি বালুর কারণে নৌযান চলাচল ব্যাহত হয় তাহলে পানি উন্নয়ন বোর্ড নদীতে নৌযানের গতিপথ সচল করার জন্য বালু উত্তোলন করতে পারবে। তবে তার আগে জেলা প্রশাসকের সঙ্গে অবশ্যই যোগাযোগ করতে হবে। অন্যথায় এ নদী থেকে আর বালু উত্তোলনের কোনো সুযোগ নেই।