কক্সবাজারে আসছে না দুই প্রজাতির কাছিম

কক্সবাজারের টেকনাফ সৈকতে ভেসে আসা অলিভ রিডলে প্রজাতির মৃত মা কাছিমফাইল ছবি

কক্সবাজারের বালুকাময় সৈকতে আজ থেকে ১০-১২ বছর আগেও হক্সবিল, গ্রিন টার্টল ও অলিভ রিডলে-এই তিন প্রজাতির কাছিম আসত ডিম পাড়তে। কিন্তু নানা কারণে সৈকতে ডিম পাড়ার পরিবেশ বিপন্ন হয়ে ওঠায় হক্সবিল ও গ্রিন টার্টল আর ডিম পাড়তে আসছে না। তবে অলিভ রিডলে টার্টল এখনো আসছে এই সৈকতে। এই প্রজাতির কাছিম ডিম পাড়তে এসে মারাও পড়ছে জালে আটকা পড়ে।

সমুদ্রবিজ্ঞানী ও বাংলাদেশ মৎস্য উন্নয়ন করপোরেশনের চেয়ারম্যান সাঈদ মাহমুদ বেলাল হায়দার প্রথম আলোকে বলেন, কক্সবাজার সৈকতে একটা সময় দল বেঁধে ডিম পাড়তে আসত হক্সবিল, গ্রিন টার্টল ও অলিভ রিডলে প্রজাতির কাছিম। এখন হক্সবিল ও গ্রিন টার্টলের দেখা মিলছে না। যে সৈকতে ডিম পাড়ার নিরাপদ পরিবেশ থাকে না, সেখানে কখনোই যায় না হক্সবিল ও গ্রিন টার্টল। গত ১০ বছরে কক্সবাজার সৈকতে ওই দুই প্রজাতির কাছিমের দেখা মেলেনি। দল বেঁধে তারা ডিম পাড়তে যাচ্ছে ভারতের আন্দামান দ্বীপপুঞ্জ ও ওডিশা সৈকতে।

২ মাসে ৩০০ মা কাছিমের মৃত্যু

গতকাল রোববার বিকেলে শহরের নাজিরারটেক সৈকতে একটি কাছিমের মৃতদেহ ভেসে উঠে। কাছিমের মুখ ও হাতে আঘাতের চিহ্ন। কুকুর কাছিমটির অর্ধেক অংশ খেয়ে ফেলে। দুর্গন্ধ ছড়িয়ে পড়ায় স্থানীয় লোকজন কাছিমটি বালুতে পুঁতে ফেলেন।

সৈকতের দরিয়ানগর, হিমছড়ি ও টেকনাফ সৈকতেও তিনটি কাছিমের মৃতদেহ ভেসে আসে। কাছিমের মৃত্যু থামানো যাচ্ছে না জানিয়ে বাংলাদেশ সমুদ্র গবেষণা ইনস্টিটিউটের জ্যেষ্ঠ বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা তরিকুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, গত জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসে সৈকতের টেকনাফ, বাহারছড়া, ইনানি, হিমছড়ি, দরিয়ানগর, কলাতলী, সমিতিপাড়া, নাজিরারটেক থেকে অন্তত ১০৩টি মা কাছিমের মরদেহ উদ্ধার করা হয়। সব কটি অলিভ রিডলে প্রজাতির। অধিকাংশ কাছিমের শরীরে আঘাতের চিহ্ন ছিল, পেটে ছিল ৫০-৮০টি করে ডিম।

আবার একই সময়ে সৈকতের বিভিন্ন পয়েন্টে ১১৬টি অলিভ রিডলে ডিম পেড়ে সাগরে ফিরে গেছে। এসব কাছিমের পাড়া প্রায় ১৫ হাজার ডিম হ্যাচারিতে সংরক্ষণ করা হয়েছে।

হক্সবিল ও গ্রিন টার্টলের ডিম পাড়ার তথ্য তাঁর জানা নেই জানিয়ে তরিকুল ইসলাম বলেন, তবে ২০২৩ সালের ১০ জানুয়ারি সুন্দরবনের দুবলার চরে একটি এবং ১৪ জানুয়ারি সেন্ট মার্টিন দ্বীপের সৈকতে একটি মৃত হক্সবিল ভেসে এসেছিল।

সমুদ্র ও প্রাণী বিশেষজ্ঞরা বলেন, সৈকত এলাকায় অপরিকল্পিত পর্যটন ও অবকাঠামো নির্মাণ, কুকুর-শেয়ালের উৎপাত ও আক্রমণ, বালিয়াড়ি ধ্বংস, সমুদ্রতীরে বৈদ্যুতিক বাতির ঝলকানি, মানুষের হইচই-কোলাহলে সামৃদ্রিক কাছিমের ডিম পাড়ার পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে।

কক্সবাজার বন ও পরিবেশ সংরক্ষণ পরিষদের সভাপতি দীপক শর্মা বলেন, গত জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসে কক্সবাজার সৈকত থেকে সরকারিভাবে ১০৩টি মা কাছিমের মরদেহ উদ্ধারের কথা বলা হলেও প্রকৃত সংখ্যা প্রায় ৩০০টি। জোয়ারের সময় কাছিম ভেসে এলে বেওয়ারিশ কুকুর, শেয়াল, গুইসাপ খেয়ে ফেলে। মরা কাছিম থেকে দুর্গন্ধ ছড়িয়ে পড়লে অনেক সময় জেলেরা বালুচরে পুঁতে ফেলেন। এসব হিসাবে ধরা হয় না। সাগরে পুঁতে রাখা নিষিদ্ধ ফাঁদজাল (বিহিন্দি, কারেন্ট, ভাষা ও ট্রলিং জাল) উচ্ছেদ করা হলে ভেসে আসা মৃত ৩০০ মা কাছিম থেকে অন্তত ১৫ হাজার ডিম (গড়ে ৫০টি করে) এবং ডিম থেকে বাচ্চা পাওয়া যেত।

টেকনাফ সৈকতে বেশি উদ্ধার

চলতি মৌসুমের মধ্যে সবচেয়ে বেশি মা কাছিমের মৃতদেহ ভেসে আসে টেকনাফ সৈকতে। গত ২৩ ফেব্রুয়ারি একদিনে টেকনাফের বাহারছড়া, শিলখালী, জাহাজপুরা সৈকত থেকে উদ্ধার করা হয় ২৫টি মা কাছিমের মৃতদেহ।

এর মধ্যে ৯টি কাছিম উদ্ধার করেন পরিবেশকর্মী ও বেসরকারি সংস্থা কোডেকের ডিম সংরক্ষক মোহাম্মদ ইউসুফ ও মো. হাশেম। মো. ইউসূফ বলেন, ১০ থেকে ২৫ বছর ধরে তাঁরা কয়েকজন সৈকত থেকে কাছিমের ডিম সংগ্রহের কাজ করছেন। কিন্তু এক দিনে ২৫টি মরা কাছিম ভেসে আসার দৃশ্য দেখেননি। সব কটি কাছিমের শরীরে আঘাতের চিহ্ন এবং পেটে ৫০-৮০টি ডিম ছিল। কয়েকটি কাছিমের গায়ে জাল পেঁচানো ছিল। জালে কাছিম আটকা পড়লে ছেড়ে না দিয়ে জেলেরা লাঠি দিয়ে পিটিয়ে হত্যা করে সাগরে নিক্ষেপ করে। পরে তা জোয়ারের পানিতে উপকূলে ভেসে আসে।

মৎস্য ও সামুদ্রিক প্রাণী বিশেষজ্ঞরা বলেন, ২০১০ সালের দিকে কক্সবাজার সৈকতে দৈনিক ২০০-৩০০টি কাছিম ডিম পাড়তে আসত। এখন দিনে একটিও আসে না। তবে প্রতিদিন কোনো না কোনো সৈকতে মা কাছিমের মৃতদেহ ভেসে আসছে। কাছিমের মৃত্যু কেন হচ্ছে, তা নিয়ে গবেষণাও হচ্ছে না। কাছিম রক্ষায় প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ না নিলে হক্সবিল, গ্রিন টার্টলের মতো একদিন অলিভ রিডলেও হারিয়ে যাবে।