মাসিক নিয়ে নানা কুসংস্কার উঠে এল কিশোরীদের প্রশ্নে, চিকিৎসকেরা দিলেন উত্তর

বগুড়ার সারিয়াকান্দির মথুরাপাড়া আনিলা জাহান মেমোরিয়াল বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্রীদের মাসিককালীন স্বাস্থ্য সচেতনতা নিয়ে বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেন চিকিৎসকেরা। রোববার দুপুরে
ছবি: প্রথম আলো

সারিয়াকান্দি উপজেলার কর্ণিবাড়ি ইউনিয়নের যমুনাপারের দুর্গম মথুরাপাড়া আনিলা জাহান মেমোরিয়াল বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের নবম শ্রেণির একজন ছাত্রী বলে, তার মা তাকে বলেছেন, মাসিকের সময়ে টকজাতীয় খাবার এবং ডাবের পানি খাওয়া যাবে না। এতে শরীর থেকে বেশি রক্ত ঝরবে। সেই থেকে ভয়ে সে মাসিকের সময়ে টক ও ডাবের পানি এড়িয়ে চলে। আসলেই মাসিকের সময়ে ডাবের পানি এবং টক খেলে স্বাস্থ্যঝুঁকি আছে কি না, চিকিৎসকদের কাছে জানতে চায় সে।

বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণির আরেক ছাত্রী বলে, তার মা তাকে বলেছে, মাসিকের সময়ে কাঁচা পেঁয়াজ ও ঠান্ডা পানি খাওয়া যাবে না। খেলে শরীর ভেঙে পড়বে। আসলেই এমনটা ঘটে?

জবাবে বগুড়া সদর উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা সামির হোসেন বলেন, মাসিকের সময়ে টক, কাঁচা পেঁয়াজ, ঠান্ডা পানি, ডাবের পানি খেলে রক্তপাত বেড়ে যাবে—এর কোনো ভিত্তি নেই। এটা কুসংস্কার। মাসিকের সময়ে স্বাভাবিক সব খাওয়া যাবে। পুষ্টিকর খাবারে জোর দিতে হবে।

এভাবে রোববার ঋতুস্রাব স্বাস্থ্য সচেতনতা দিবসে মথুরাপাড়া আনিলা জাহান মেমোরিয়াল বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ে মাসিক নিয়ে কিশোরীদের নানা প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন চিকিৎসকেরা।

অনুষ্ঠানে চিকিৎসক সামির হোসেন ছাড়াও মাসিককালীন নানা সমস্যা ও স্বাস্থ্যগত জটিলতা নিয়ে পরামর্শ দেন বগুড়া সদর উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তার কার্যালয়ের চিকিৎসা কর্মকর্তা আসমা হক, সারিয়াকান্দি উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা মো. মাহবুব হোসেন সরদার প্রমুখ। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন বগুড়া-১ (সারিয়াকান্দি-সোনাতলা) আসনের সংসদ সদস্য সাহাদারা মান্নান।

অনুষ্ঠানে চিকিৎসক সামির হোসেন বলেন, মেয়েদের মাসিক বা ঋতুস্রাব কোনো লজ্জার বিষয় নয়। বয়ঃসন্ধিকালে শারীরিক পরিবর্তন এবং সমস্যা নিয়ে মা-বাবার সঙ্গে খোলামেলা আলোচনা করতে হবে। লজ্জা ভেঙে কিশোরী মেয়েদের সঙ্গে মা-বাবাকেও এসব নিয়ে খোলামেলা কথা বলতে হবে। কিশোরী মেয়েদের পরিবার থেকেই মাসিককালীন স্বাস্থ্য সচেতন করতে হবে। পেটব্যথা হলে মেয়েরা যাতে ভীত না হয়, ঘাবড়ে না যায়—এসব বিষয়ে সাহস দিতে হবে।

চিকিৎসকদের কাছে প্রশ্ন করছেন বিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থী
ছবি: প্রথম আলো

অনুষ্ঠানে স্কুলছাত্রীদের মধ্যে বিনা মূল্যে স্যানিটারি ন্যাপকিন বিতরণ করা হয়। সোশ্যাল মার্কেটিং কোম্পানি লিমিটেডের সহযোগিতায় এর আয়োজন করে ‘রেসকিউ আওয়ার পিপল এভার’ নামের একটি প্রতিষ্ঠান।

প্রশ্নোত্তর পর্বে বিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষার্থী জানায়, মাসিকের সময় তারা পুরোনো কাপড়ের টুকরা ব্যবহার করে। এভাবে একই কাপড় একাধিক দিন ব্যবহার করে। স্যানিটারি ন্যাপকিন কেনার সামর্থ্য নেই তাদের।

দশম শ্রেণির এক ছাত্রী বলে, তার মাসিক শুরু হয় কয়েক বছর আগে। তার দাদি তাকে বলেছেন, মাসিকের সময়ে মাথায় তেল দেওয়া যাবে না। এতে শরীর থেকে রক্ত বেশি ঝরবে। দশম শ্রেণির আরেক ছাত্রীর প্রশ্ন ছিল, মা-দাদির কাছ থেকে শুনেছে, মাসিকের স্থায়িত্ব সর্বোচ্চ সাত দিন। কিন্তু তার মাসিক শুরু হলে রক্তপাত হয় সাত দিনের বেশি। মাসিকের ব্যথাও হয় তীব্র। এটা কি কোনো সমস্যা?

কিশোরীদের এসব প্রশ্নের উত্তরে বগুড়া সদর উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তার কার্যালয়ের চিকিৎসা কর্মকর্তা আসমা হক বলেন, মাসিকের রক্তপাত এক মাসের বেশি সময় ধরে হলে অভিজ্ঞ চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে, পরামর্শ নিতে হবে। আর ঋতুস্রাবে ব্যথা খুব স্বাভাবিক বিষয়। এতে ঘাবড়ানোর কিছু নেই।

আসমা হক আরও বলেন, স্যানিটারি ন্যাপকিন কেনার সামর্থ্য না থাকলে মাসিকের সময়ে কাপড় ব্যবহারে কোনো সমস্যা নেই। তবে কাপড়ের টুকরাটা আগে সাবান–পানি বা ডেটল–পানি দিয়ে জীবাণুমুক্ত করে নিতে হবে। কাপড় বা স্যানিটারি প্যাড পাঁচ ঘণ্টার বেশি ব্যবহার করা যাবে না। কাপড় ব্যবহার করলে পাঁচ ঘণ্টা পর তা বদলে সাবান ও গরম পানিতে পরিষ্কার করে দীর্ঘক্ষণ রোদে শুকাতে হবে। অস্বাস্থ্যকর কাপড়ের টুকরা ব্যবহার করা যাবে না। এতে জরায়ুতে নানা রোগ হওয়ার ঝুঁকি থাকে।

অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন রেসকিউ আওয়ার পিপল এভার–এর সভাপতি তাহমিনা পারভীন। প্রধান অতিথির বক্তব্যে সংসদ সদস্য সাহাদারা মান্নান বলেন, মাসিক নিয়ে এখনো গ্রামের কিশোরী মেয়েদের মধ্যে লজ্জা ও স্বাস্থ্য সচেতনতার অভাব রয়েছে। মাসিক নিয়ে এ ভীতি ও জড়তা কাটিয়ে মেয়েদের স্বাস্থ্য সচেতন হতে হবে।

অনুষ্ঠানে অন্যদের মধ্যে মথুরাপাড়া আনিলা জাহান মেমোরিয়াল বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক শেলিনা আকতার এবং এসএমসি এন্টারপ্রাইজ লিমিটেডের সেলস ম্যানেজার এ এস এম শামসুল আলম বক্তব্য দেন।