৮ হাজার কোটি টাকা ব্যয়, তবু পানির কষ্টে মানুষ

মোহাম্মদ সাইফুল ইসলামের বাড়ি চট্টগ্রামের দক্ষিণ পতেঙ্গা ওয়ার্ডের নাজিরপাড়া এলাকায়।

তাঁর বাড়ির ছাদে দাঁড়ালে সমুদ্র দেখা যায়। বলতে গেলে পানির রাজ্যেই থাকেন তিনি, কিন্তু সে পানি পানের অযোগ্য। তাঁর বাড়িতে ওয়াসার সরবরাহ সংযোগও নেই। তাই পানির সংকটে দিশাহারা পরিবারটি।

সম্প্রতি নাজিরপাড়া এলাকায় গিয়ে কথা হয় মোহাম্মদ সাইফুল ইসলামের সঙ্গে। পানির সংকটের কথা তুলে ধরে হতাশাই প্রকাশ করলেন তিনি। বলেন, বাড়ির পাশে আগে পুকুর ছিল। সেটি ভরাট হয়ে গেছে। খাওয়ার পানির জন্য ছিল নলকূপ। সেটিতেও পানি ওঠে না। পাইপ সংযোগ দেওয়ার জন্য ওয়াসাকেও কয়েকবার বলা হয়েছে, কিন্তু লাভ হয়নি। এখন কেনা পানিতে ধোয়ামোছা ও রান্নাবান্নার কাজ সারতে হচ্ছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বর্তমানে চট্টগ্রামে পানির চাহিদা ৫৬ কোটি লিটার। উৎপাদন সক্ষমতা দৈনিক ৫০ কোটি লিটার। গ্রাহক সংযোগ রয়েছে ৯৮ হাজার।

গত দেড় দশকে পানি সরবরাহের জন্য ৮ হাজার ৮০০ কোটি টাকা ব্যয়ে আটটি ছোট-বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে চট্টগ্রাম ওয়াসা। কিন্তু নাজিরপাড়ায় কোনো পাইপ সংযোগ বসেনি। অবশ্য শুধু ওই এলাকায় নয়, চট্টগ্রামের শতাধিক এলাকায় একই অবস্থা। ওয়াসার পাইপ সংযোগই বসেনি এখনো। এতে পানির তীব্র সংকটে দিন পার করছেন অন্তত ১২ লাখ মানুষ। নগরের বিভিন্ন এলাকার বাসিন্দা, ওয়াসার প্রকৌশলী, মিটার পরিদর্শক ও রাজস্ব শাখার কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।

ওয়াসার নথি ঘেঁটে দেখা গেছে, ১৯৬৩ সালে মাত্র তিনটি গভীর নলকূপ নিয়ে যাত্রা শুরু করেছিল চট্টগ্রাম ওয়াসা। এরপর কেটে গেছে ৬২ বছর। অথচ নগরে কী পরিমাণ পানির চাহিদা, আগামী ২০ কিংবা ৩০ বছর পর সেই চাহিদা কত হবে, কীভাবে চাহিদা মেটানো যাবে, কোন এলাকায় চাহিদা বাড়বে—এসবের বিস্তারিত তথ্য সংস্থাটির কাছে নেই। কেননা, এত বছরেও পানি সরবরাহের মহাপরিকল্পনা তৈরি হয়নি। ওয়াসার এক

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বর্তমানে চট্টগ্রামে পানির চাহিদা ৫৬ কোটি লিটার। উৎপাদন সক্ষমতা দৈনিক ৫০ কোটি লিটার। গ্রাহক সংযোগ রয়েছে ৯৮ হাজার।

ওয়াসা সূত্র জানায়, সিটি করপোরেশনের ১, ২, ১০, ১১, ১৮, ৩৭ থেকে ৪১ নম্বর—এই ১০ ওয়ার্ডে পানির সংকট বেশি। শতাধিক এলাকায় নেই ওয়াসার সংযোগ। বাসিন্দারা গভীর নলকূপ, কেনা পানি, পুকুর ও জলাশয়ের ওপর নির্ভরশীল।

পানি পান না অন্তত ১২ লাখ

হাজার কোটি টাকা খরচের পরও ওয়াসার হিসাবে ৬৫ শতাংশ মানুষ পানি পান। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো থেকে ২০২২ সালে প্রকাশিত জনশুমারি ও গৃহগণনা প্রতিবেদন অনুযায়ী, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন এলাকায় জনসংখ্যা ৩২ লাখ ৩০ হাজার ৫০৭। যদিও সিটি করপোরেশনের হিসাবে, নগরের আনুমানিক জনসংখ্যা ৬০ লাখ। তবে ওয়াসা পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য ধরে প্রকল্পের পরিকল্পনা করে। ফলে ৩২ লাখ ৩০ জনসংখ্যার মধ্যে প্রায় সাড়ে ১১ লাখ মানুষ পানির সুবিধা পান না। আবার সিটি করপোরেশনের জনসংখ্যার হিসাব ধরলে ২১ লাখ মানুষের দুয়ারে পানি পৌঁছায় না।

ওয়াসা সূত্র জানায়, সিটি করপোরেশনের ১, ২, ১০, ১১, ১৮, ৩৭ থেকে ৪১ নম্বর—এই ১০ ওয়ার্ডে পানির সংকট বেশি। শতাধিক এলাকায় নেই ওয়াসার সংযোগ। বাসিন্দারা গভীর নলকূপ, কেনা পানি, পুকুর ও জলাশয়ের ওপর নির্ভরশীল।

শতাধিক এলাকায় পানির সংযোগ না যাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন ওয়াসার প্রধান প্রকৌশলী মাকসুদ আলম। সম্প্রতি নিজ কার্যালয়ে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, একসময় পানির উৎপাদন ছিল ১০ কোটি লিটার। এখন দিনে ৫০ কোটি লিটার পানি পরিশোধন করে সরবরাহের সক্ষমতা তৈরি হয়েছে। তবে এখনো অনেক এলাকায় পানি দেওয়া যাচ্ছে না। এ জন্য মহাপরিকল্পনা তৈরি করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এতে কোন এলাকা পিছিয়ে, ভবিষ্যতে কী পরিমাণ পানি প্রয়োজন হবে, কয়টি পরিশোধনাগার তৈরি হবে—তা বিস্তারিত উঠে আসবে।

শহরের জনসংখ্যা ক্রমাগত বাড়ছে। বাড়ছে পানির চাহিদা। এখনো অনেক এলাকায় পাইপ বসেনি। আবার অনেক এলাকায় পাইপলাইন বসলেও নিয়মিত পানি যায় না। ফলে এ সংকটের সমাধানে সঠিক পরিকল্পনা করে এগোতে হবে।
চুয়েট স্থাপত্য ও পরিকল্পনা অনুষদের ডিন অধ্যাপক মুহাম্মদ রাশিদুল হাসান

মহাপরিকল্পনা ছাড়াই যত প্রকল্প

মহাপরিকল্পনা ছাড়াই ওয়াসা এত দিন একের পর এক প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে। সংস্থাটির প্রথম পানি শোধনাগার প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয় ১৯৮৭ সালে। এরপর ২২ বছর আর কোনো বড় প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়নি। ২০০৯ সালের পর গত ১৫ বছরে পানি সরবরাহে ছোট-বড় আটটি প্রকল্প নেওয়া হয়। এই আট প্রকল্পে ব্যয় হয়েছে অন্তত ৮ হাজার ৮০০ কোটি টাকা।

নথি অনুযায়ী, আটটির মধ্যে পানি সরবরাহে সবচেয়ে বড় প্রকল্প ছিল চারটি। এগুলো হলো ১ হাজার ৮৪৮ কোটি টাকা ব্যয়ে কর্ণফুলী পানি সরবরাহ প্রকল্প (প্রথম পর্যায়), ১ হাজার ৮৯০ কোটি টাকায় চট্টগ্রাম পানি সরবরাহ উন্নয়ন ও পয়োনিষ্কাশন প্রকল্প, ৩ হাজার ৮২ কোটি টাকার কর্ণফুলী পানি সরবরাহ প্রকল্প (দ্বিতীয় পর্যায়) ও ১ হাজার ৯৯৪ কোটি টাকা ব্যয়ে ভান্ডালজুরী পানি সরবরাহ প্রকল্প। বড় প্রকল্পগুলো নির্ধারিত মেয়াদে শেষ হয়নি। কয়েক দফা মেয়াদ ও ব্যয় বাড়াতে হয়েছে।

পানিসংকটের সমাধানে দ্রুততম সময়ের মধ্যে মহাপরিকল্পনা বা মাস্টারপ্ল্যান তৈরি করা উচিত বলে মনে করেন চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (চুয়েট) স্থাপত্য ও পরিকল্পনা অনুষদের ডিন অধ্যাপক মুহাম্মদ রাশিদুল হাসান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, শহরের জনসংখ্যা ক্রমাগত বাড়ছে। বাড়ছে পানির চাহিদা। এখনো অনেক এলাকায় পাইপ বসেনি। আবার অনেক এলাকায় পাইপলাইন বসলেও নিয়মিত পানি যায় না। ফলে এ সংকটের সমাধানে সঠিক পরিকল্পনা করে এগোতে হবে।